মানব চরিত্রের কতগুলো মন্দ বৈশিষ্ট্য আছে যা থেকে মুক্ত থাকতে আপনাকে সদা সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ ঐসব দোষ মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এসব দোষসমূহ হচ্ছে যথাঃ
ক. অহংকার
আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথে অন্যতম বড় বাধা হচ্ছে অহংকার। এটা হচ্ছে বিনয় এবং নম্রতার বিপরীত এক চরিত্র ধ্বংসকারী বৈশিষ্ট্য। তাযকিয়ার মাধ্যমে আমরা তিলে তিলে চরিত্র গঠনের যে ভিত্তি রচনা করি অহংকার নিমিষে তা ধ্বংস করে দেয়। হাদীসে বলা হয়েছে, “যার অন্তরে তিল পরিমাণ অহংকারও আছে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে না।”
এই হাদীস শুনে একজন সাহাবী রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করল, “হে রাসূল! যদি কেউ উত্তম পোষাক পড়তে এবং সুন্দর জুতা পায়ে দিতে পছন্দ করে?” উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ নিজে সুন্দর তাই তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা আর অপরজনকে খাটো করা এবং অবজ্ঞা করা।” (মুসলিম)
যখনই আপনার মনে হবে যে আপনি বড় কিছু হয়েছেন, মনে করবেন যে তখনই আপনার আধ্যাত্মিক মৃত্যু হয়েছে। কাজেই আপনার সকল সৎ এবং উত্তম প্রচেষ্টার সফল সমাপ্তি তখনই হবে যদি আপনি বিনয়ী হতে পারেন। সবসময় মনে রাখবেন যা কিছু আপনি অর্জন করেছেন সবই আল্লাহর দান, কোনটাই নিছক আপনার চেষ্টায় অর্জিত নয়।
দ্বিতীয়তঃ মনে রাখবেন আপনার জন্য আদর্শ হচ্ছে রাসূল (সাঃ) এর জীবন অনুসরণ। তাঁর জীবনেই রয়েছে অনুকরণীয় আদর্শ। “এতে কোন সন্দেহ নেই যে আপনি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত।” (আল-কুরআন ৬৮:৪) যেহেতু আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ এত উঁচু মানের ও উত্তম সেহেতু তাঁর অনুসরণে আমাদের সারা জীবনই নৈতিক মান উন্নত করতে হবে। যদি কারো অনুকরণীয় আদর্শ এমন হয় যা সহজেই অর্জন করা যায় তবে শীঘ্রই তার মধ্যে এই তৃপ্তি এসে যায় যে সে যথেষ্ট ভাল মান অর্জন করে ফেলেছে আর এই তুষ্টি তার আরও ভাল হবার চেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করে। যেহেতু আমাদের মুসলমানদের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত জীবনের আদর্শ অনেক উচ্চমানের সেহেতু আমাদের জীবনভর নিজেদের আরও ভাল করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হবে। এই জীবনভর উত্তম হবার চেষ্টা আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাবে। যদি এই অব্যাহত প্রচেষ্টায় কোন পর্যায়ে আমাদের মাঝে গৌরব বা অহংবোধের উপক্রম হয় তবে বুঝতে হবে এটা শয়তানের পক্ষ থেকে এসেছে। যেই শয়তান আমাদের জ্ঞান ও আমল এর পরীক্ষা নিতে চায়।
আপনার তিল তিল করে অর্জন করা সকল কামেলিয়াত মুহূর্তের মাঝে ধ্বংস করে দিতে পারে এই অহংকার। কাজেই নিজেকে এই অহংকার থেকে বাঁচান। মনে রাখবেন এই গর্ব অহংকার অনেক সময় অত্যন্ত আকর্ষণীয় উপায়ে, মনের অনেক বেখেয়ালের বশে এসে যেতে পারে। অতএব সতর্ক থাকুন!
একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল (সাঃ) একজন বিনয়ী মুমিনের যার হৃদয় সকল গর্ব-অহংকার মুক্ত এবং পবিত্র (খালিস) তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন “আমার বান্দাদের মধ্যে সেই আমার বেশী প্রিয় যে জীবিকার পেছনে ন্যুনতম সময় দেয় আর আল্লাহর স্মরণে বেশী সময় দেয়; যে তার রবের ইবাদতে একনিষ্ঠ এবং তাঁর প্রকৃত অনুগত; যে জনগণের মাঝে কম পরিচিত (প্রচার বিমুখ); যার জীবিকা মাত্র চলার জন্য যথেষ্ট এবং এতেই সে সন্তষ্ট। তার মৃত্যু তাড়াতাড়ি আসবে, তাঁর অন্তিম যাত্রায় কম মানুষ থাকবে এবং তার রেখে যাওয়া সম্পদ হবে নগন্য।” (তিরমিযি)
কাজেই আপনি এভাবে আল্লাহর পথে কাজ করায় রত থাকুন। আমাদের রব তাঁর পথে কাজের কথা স্মরণ করাবার জন্য টিভি পর্দায় উপস্থিত হবেন না। হতে পারে তাঁর পথে চলার জন্য পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখা হবে না। তিনি আকর্ষণীয় বক্তৃতার মাধ্যমে সমাবেশের শ্রোতাদের আকর্ষণ করবেন না। কিন্তু তারপরও একজন মুমিন মুহুর্তের জন্য তাঁর স্মরণ বিস্মৃত হবেন না। বিপদ, আপদ, পরীক্ষা এমনকি পরাজয়ের মুখেও মুমিন খোদাবিমুখ হবে না। সে কখনও তার সাফল্য বা বিজয়ের সম্ভাবনার হিসাব করবে না বরং সে সাফল্যের একটা মাত্র উপায়ই জানে তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন। এটা সে তার সকল সাধ্য নিয়োজিত করে পালন করে। এমন মুমিনই ইসলামী আন্দোলনের অকাট্য শক্তি, উম্মাহর মেরুদন্ড স্বরুপ।
খ. শঠতা
একজন ঈমানদারের সকল নেক আমল নষ্ট করে দেয় এমন আরেকটি বদগুণ হচ্ছে নিফাক। নিফাক মানে শঠতা বা প্রদর্শন এবং এমন ভাল বৈশিষ্ট্যের অভিনয় যা আসলে নিজের মধ্যে নেই। রাসূল (সাঃ) এমন বৈশিষ্ট্যের নিন্দা করেছেন এভাবে “যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে সে একজন মূর্তিপূজারীর সমতূল্য কারণ সে অন্যকে আল্লাহর সমপর্যায়ের মনে করেছে; তেমনি যে অন্যদের দেখানোর জন্য দান করছে সেও আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করছে।” (আহমদ) তিনি আরও বলেছেন, “একজন মুনাফিকের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোযা রাখে এবং দাবী করে সে মুসলিম সে বৈশিষ্ট্য তিনটি হচ্ছে, প্রথমত- সে মিথ্যা কথা বলে, দ্বিতীয়ত- সে ওয়াদা ভঙ্গ করে, তৃতীয়ত- সে বিশ্বাস ভঙ্গ করে।” (বুখারী, মুসলিম)
শঠতা হচ্ছে এমন খারাপ বৈশিষ্ট্য যা আপনার ঈমানকে আড়াল করে। এটা এমনভাবে আপনার চরিত্র ধ্বংস করে যেমন উইপোকা কাপড়কে খেয়ে ফেলে। নিফাক হচ্ছে ইখলাস এর বিপরীত। ইখলাস হচ্ছে ভাল কাজ ও ঈমানের অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। কাজেই আপনি পুনঃপুন আপনার কাজ ও নিয়াতকে ইখলাস ও নিফাক এর সাপেক্ষে যাচাই ও বিচার করবেন।
গ. হতাশাবাদ
আল্লাহর নিকটবর্তী হবার পথে আরেকটি বাধা হচ্ছে নিরাশা বা হতাশাবাদ। অবশ্যই নিরাশা বা হতাশা থেকে মুক্ত থাকতে সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমতের উপর নিরাশ হওয়াকে কুফরী কলেছেন। তিনি বলেছেন, “সে ধ্বংস হবে যে আল্লাহর রহমতের বিষয়ে নিরাশ হয়।” (আল-কুরআন ১৫:৫৬) আপনি যদি শতবারও চেষ্টা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন তবু নিশ্চিত থাকুন যে প্রতিবারের চেষ্টার জন্য আপনি অপরিমিত পূণ্য লাভ করছেন। এভাবে ভাবলে মুমিনদের মনে কখনও পরাজিত বা হতাশাভাব আসবে না। আল্লাহ যা ওয়াদা করেছেন তা অবশ্যই সত্য এবং তা আসবেই, “আর যারা আমার চেস্টা সাধনা করবে তাদের আমি অবশ্যই পথ দেখাবো। আর আল্লাহ নিশ্চিতই সৎকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।” (আল-কুরআন ২৯:৬৯) অতএব সর্বদা আশাবাদী ও ইতিবাচক মনোভাব রাখুন। আজীবন আশাবাদী থাকুন।
সূত্রঃ বিআইআইটি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট) কর্তৃক প্রকাশিত “সুবহে সাদিক” গ্রন্থ
দ্বিতীয় পর্বঃ আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার পথে বাধাসমূহ