আমার প্রাণের কোণে এ শূণ্যতা কেন? মর্মতলে তপ্ত ব্যথা লুক্কায়িত কেন? আমার হৃদয়ের সকল আনন্দ স্তব্ধ করিয়া রহিয় রহিয়া এ হাহাকার কেন? আমি জানি না, আমি বুঝি না, কি এ?- কিসের ব্যথা? কেন এ ব্যর্থতাবোধ? কর্মের মধ্যে ডুবিয়া থাকি, হাসির মধ্যে মজিয়া যাই, কিন্তু শূন্যতা ত দূর হয় না, হৃদয়ের কোন এক নিভৃত কোণ শূন্য হইয়া পড়িয়া আছে কিছুতেই তাহা পূর্ণ হয় না। কে আমাকে থাকিয়া থাকিয়া ডাকিয়া যায়। সুখের সৌধ ভেদিয়া কাহার স্বর শুনা যায়। কাহার মহাধ্বনি সকল ধ্বনি স্তব্ধ করিয়া প্রাণের মধ্যে বাজিয়া উঠে। আমার মন-প্রাণ উদাস আকুল চঞ্চল হইয়া পড়ে।
প্রভাতের মৃদু মলয়ে কে আমার মর্মতলে স্নেহ-স্পর্শ বুলাইয়া দেয়? ঊষার সুরভি-শ্বাসে জীবনের আহ্বান আনে? আকাশ বাতাস নিত্য নবীন জীবন গানে পূর্ণ করিয়া জীবনধারা নবীন বেগে বহাইয়া দেয়? আমি অবাক হইয়া ভাবি, আমি ব্যাকুল হইয়া দেখি, -আঁধারে এ আলোর মেলা মরণ জীবনের খেলা! আমি মহিমা দেখিয়া চাহিয়া রই। আমার নয়ন ভরিয়া সলিল আসে, হৃদয় আমার নিবেদনের বেগে কম্পিত হয়।
সায়াহ্নে কার শান্ত শোভায় হৃদয় মন ভরিয়া যায়? কে শ্রমের মাঝে শান্তি আনে? ভীষণতায় মধু বহায়? কে আমাকে হিল্লোলে ডাকিয়া যায়? বৃক্ষের পত্রে পত্রে, সোনার ধানে দুলিয়া দুলিয়া খেলিয়া যায়? আমি ছুটিয়া যাই, আবেগে বাহু বাড়াইয়া আমার সমস্ত প্রাণ উদাস আকুল চঞ্চল হইয়া উঠে। থামাও, তোমার কলগান থামাইয়া দাও। তোমার আনন্দ মেলা মিটাইয়া দাও, সন্ধ্যার মৌন অন্ধকারে বিশ্বের বিরাট ব্যথা আমার মনের সঙ্গে মিলাইয়া লই। দিনান্তের ম্লান আভায়, এ ধায়া ও মলিনতায়, এই মৌন স্বচ্ছ অন্ধকার বিশ্বে বিষণ্ন মুখে কিসের ব্যথা মূর্ত হইয়া প্রকাশ পায়! আমার সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হইয়া পড়ে, হৃদয় হাহাকার করিয়া উঠে, মনে হয় কিছুই বলা হয় নাই, কিছুই বলা হয় নাই। মিথ্যা- আমার দিনের আলো মিথ্যা, আমার কর্মকোলাহল মিথ্যা, আমার উল্লাস আবেগ মিথ্যা। কোথায় আমার পরমাত্মীয় পড়িয়া আছে, জীবনের সর্বস্ব কোথায় ফেলিয়া আসিয়াছি, তাহারই সন্ধান চাই, তাহারই মিলন চাই, নহিলে সবই ব্যথা ও ব্যর্থতাময়, আমার সবই শূন্য ও অন্ধকার।
আমি মৌনতার মাঝে মঝিতে চাই, আমি অন্ধকারে ডুবিতে চাই, অসীমে আমি মিশিতে চাই, গম্ভীরে নিশার অন্ধকারে অসীমের কি প্রকাশ দেখি! বিরাটের কি মহা আভাস বিশ্ব ভরিয়া ভাসিয়া আসে! অন্ধকারে দিগন্ত নাই, বিশ্বব্যোমের বিভেদ নাই, আকাশের অন্ত নাই, শূন্যের সীমা নাই। অসীমের সহিত সীমার সমাহারে এই শূন্যতাময় স্তব্ধ গভীর মহাকালে এমন মৌন মুগ্ধ রুদ্ধ হইয়া বিশ্ব কাহার ধারণা করে? ধ্বনির পর ধ্বনি রুদ্ধ করিয়া বিশ্বময় কাহার চরণোপান্তে উত্থিত হয়? আমি ধ্যানের মধ্যে ডুবিয়া যাইব, আমি ধ্বনির সঙ্গে মিশিয়া যাইব, আমি অনন্তে উত্থিত হইব।
আমার অন্তরের সহিত আত্মীয়তা আছে, মধ্যদিনের রুদ্রালোকে এই কথাই আমি স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাই। সংসার রূপ-রসের পসরা মেলিয়া প্রকাশ পায়; শব্দ ছন্দের বিচিত্র মন্ত্র পড়িয়া মায়ালোক রচনা করে; এই চঞ্চল জনস্রোত, অপার কর্মস্রোত, কর্মের কোলাহল, শব্দের কলকল, অবিরাম ঝনঝন, দ্বন্দ্ব ও উপার্জন, ইহারই মধ্যে মন উদাস ও বিষণ্ন হইয়া উঠে, বিশ্ব ব্যাপিয়া ক্লান্তি ও শূন্যতা আ্শ্চর্যরূপে প্রকাশ পায়, আমি মানুষের নয়নে বদনে শ্রান্তির মিলন ছায়া দেখি, রৌদ্র-ঝলসিত আকাশতলে শ্মশানের তপ্ত নিশ্বাস দেখি,- আমার প্রাণ শিহরিয়া উঠে, বিপুল ব্যথায় হৃদয় আমার বিচলিত হয়। শূন্য- এ অসীম শূন্য, সমস্তই মায়া ও ছায়া। মিথ্যা এ আয়োজন, মিথ্যার প্রলোভন। ছায়ার মায়ায় পড়িয়া আছি। একা- আমি নিতান্ত একা, আমার চতুষ্পার্শ্বে সিন্ধু সলিল অনন্তে উচ্ছ্বসিত হইতেছে, তাহার মাঝে বিন্দুর মত আমি পড়িয়া আছি। অনন্তে আমার যাত্রা-ভুলিয়া কোথায় বসিয়া আছি। শব্দহীন কোন সীমাহীন অমৃতলোকে আমার ঘর-বিঘোরে কোথায় ভুলিয়া আছি।
দাও, দাও, শব্দ-ছন্দ স্তব্ধ করিয়া দাও, সীমার রেখা অন্ধকারে মিশাইয়া দাও, আমি নমাজ পড়িয়া অনন্তের সন্ধান লই, রূপের অতীতে ধ্বনির অতীতে সীমাহীন গভীর শান্তিলোকে উত্তীর্ণ হই, প্রাণের অনন্ত তৃষ্ণা মিটাইয়া লই।
[সংকলিত, উৎসঃ ‘শান্তিধারা’ প্রবন্ধ গ্রন্থ]
সূত্রঃ খন্দকার আবদুল মোমেন সম্মাদিত “প্রেক্ষণ” এপ্রি্ল-জুন ২০১২, সিয়াম ও সালাত সংখ্যা।