প্রায় তিন বছর আগে আমি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এর মহত্ত্বের উপর একটি বক্তৃতা শুনছিলাম। বক্তা যখন এই আয়াতটিতে আসলেনঃ
"যদি আমি এই কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি দেখতে যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা'আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।" (কুর'আন ৫৯ঃ২১)
শাইখ, মির্জা ইয়াওয়ার বেইগ, কিছু সময়ের জন্য থামলেন এবং বললেন, "আল্লাহ্ যদি পাহাড়ের উপর কুর'আনকে অবতীর্ণ করতেন, তবে তা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার বাণীর ভয়ে ধুলায় লুটিয়ে পড়তো। তবে আমাদের হৃদয়ে কোন পাথর চেপে বসেছে যে, আল্লাহ্ তা আল্লাহ্র স্মরণে তা সামান্য কেঁপেও ওঠে না।"
সূরা হাদীদে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা নিজেই এমন একটি প্রশ্ন করেছেন,
"যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।" (কুর'আন ৫৭:১৬)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এমনি এক প্রশ্ন করেছেন যা প্রত্যেক বিশ্বাসীর হৃদয়কে প্রবল আলোড়িত করা উচিত। আল্লাহ্র বাণী দ্বারা বিগলিত হওয়ার সময় কী বিশ্বাসীদের এখনো আসেনি? যখনই বিশ্বাসীরা জান্নাতের কথা পাঠ করে, তখন তা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র দরবারে কাঁদার সময় কী এখনো আসেনি? যখনই বিশ্বাসীরা জাহান্নামের কথা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে বিনয়ীভাবে আল্লাহ্র দরবারে পানাহ চাওয়ার সঠিক সময় কি আসেনি? এটা কীভাবে সম্ভব যে, একটি চলচ্চিত্র একজন বিশ্বাসীর চোখে পানি এনে দেয় (যা একেবারেই স্বাভাবিক), কিন্তু ইউসুফ আলাইহিস সালামের হৃদয়বিদারক ঘটনার উল্লেখেও আমাদের হৃদয় পাথর-কঠিন হয়ে থাকে? এ ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা পূর্ববর্তী জাতিদের উদাহরণ দিয়েছেন, যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলো এবং উল্লেখ করেছেন পরবর্তীতে তাদের কী হয়েছিলো। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল। আর এই কঠিন হৃদয় ধাবিত করলো একটি অবাধ্য আত্মার দিকে।
গত রামাদানের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেকের ক্ষেত্রেই উত্তম আমলের মান নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। আমরা দু'আ করি, কিন্তু তাতে নেই সেই ঐকান্তিকতা ও আকাঙ্ক্ষা যা আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এর সামনে প্রদর্শন করেছিলাম। সেই সময়টিতে পাপের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন আমরা আমাদের অনেক পাপকেই অবাধে ঘটে যেতে দেই। শুনে হৃদয়বিদারক মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের অনেকের জন্যই ব্যাপারটি সত্য যে, গত এক বছরে আমাদের হৃদয় আরো কঠিন হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ে এমনি একটি পাথর চেপে বসেছে, যার কারণে আল্লাহ্র স্মরণেও হৃদয় আর বিনয়ী হয় না। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমরা বিশ্বাসী। উপর্যুক্ত আয়াতটিতে আমাদের যখন কঠোর তিরষ্কার করা হয়েছে, তখনও কিন্তু আমাদের বিশ্বাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই শব্দটির মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের আশা। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,
"তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহই ভূ-ভাগকে তার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন। আমি পরিস্কারভাবে তোমাদের জন্যে আয়াতগুলো ব্যক্ত করেছি, যাতে তোমরা বোঝ।" (কুর'আন ৫৭ঃ ১৭)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার বাণীর এমনি একটি বৈশিষ্ট্য যে, প্রতিটি সতর্কবাণীর পরেই রয়েছে আশা। প্রতিটি কঠোর তিরষ্কারের পরেই রয়েছে একটি উপদেশ। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাঁর ক্রোধ কিংবা আমাদের দুর্বলতা সম্পর্কে এমনভাবে বলেননি যাতে আমরা নিজেদের একেবারে হীন ও নিচ মনে করি কিংবা আত্মকরুণার গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে পড়ি। বরং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের সতর্ক করেছেন, তাঁর শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন এবং বিশ্বাসীদের কঠোর তিরষ্কার করেছেন কেবল তাদেরকে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এবং তাঁর দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের হৃদয়ের কঠোরতার জন্য কঠিন ভাষায় তিরষ্কার করার পর তিনি আমাদের খুবই পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন। তিনিই আল্লাহ্ যিনি মৃত পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার করেন। একইভাবে তিনিই আমাদের মৃত হৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার করতে পারেন।
ভূ-পৃষ্ঠ এবং হৃদয় উভয়ই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আকাশ থেকে যা কিছু বর্ষণ করেন তার দ্বারা পুনরূজ্জীবিত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা প্রেরণ করেন বৃষ্টি, "এবং যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন পরিমিত। আতঃপর তদ্দ্বারা আমি মৃত ভূ-ভাগকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। তোমরা এমনিভাবে উত্থিত হবে।" (কুর'আন ৪৩:১১)। আর হৃদয়ের জন্য তিনি প্রেরণ করেছেন কুর'আন, "হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।" (কুর'আন ১০:৫৭)।
ভূ-পৃষ্ঠের জন্য বৃষ্টি যেমন, আমাদের হৃদয়ের জন্য কুর'আনও ঠিক তেমন। ভুমি যেমন বৃষ্টির স্পর্শে পুনরূজ্জীবন লাভ করে, আমাদের হৃদয়ও তেমনি কুর'আনের স্পর্শে পুনরূজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর একমাত্র কোন জিনিসটি পাহাড় ভেদ করে চলে যেতে পারে? সেটি কেবল পানি।
পানি পাহাড় ভেদ করে যেতে পারে এর শক্তির কারণে নয়, বরং এর দৃঢ়তার কারণে। আমাদের সামনে রয়েছে রামাদান, যে মাসে কুর'আন নাযিল হয়েছে। আকাশ থেকে প্রেরিত পানি দ্বারা আমাদের হৃদয়ে চেপে বসা পাহাড়কে আঘাত করার এর চাইতে উত্তম সময় বোধহয় আর কোনটিই হতে পারে না।
আমাদের হৃদয়কে পুনরূজ্জীবিত করার জন্য এটাই বছরের সর্বোত্তম সময়। চলুন, এই রামাদানেই আমরা আমাদের হৃদয়ে কুর'আনের বারি সিঞ্চন করি। বইটির সাথে আমাদের সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, চলুন একে আরো উন্নত করার চেষ্টা করি। হয়তো কুর'আন পাঠ করতেই আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। তারপরও এই রামাদানে কুর'আন পাঠ করার জন্য আরো বেশি সময় বের করুন। হয়তো আমরা স্বচ্ছন্দে কুর'আন তিলাওয়াত করতে পারি, তাহলে আমরা কুর'আনের একটি ভালো অনুবাদ পাঠ করা শুরু করতে পারি। কুর'আনকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা হয়তো একটি আরবী শিক্ষা কোর্সেও ভর্তি হতে পারি।
চলুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উপদেশটি আমরা আমলে নেই,
"হে কোরআনের ধারকগণ, কোরআনকে হালকাভাবে নিয়ো না। এটিকে রাতে ও দিনে যথার্থভাবে তেলাওয়াত করো। কোরআনের প্রচার ও প্রসার ঘটাও, একে সৌন্দর্যমণ্ডিত করো এবং এর উপর চিন্তাভাবনা করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।" (শু'বুল ঈমানঃ বাইহাক্বী)
সূত্রঃ VirtualMosque.com