রুটিন আমার একেবারেই অপছন্দ। তবে সকালের রুটিন হলে হিসেবটা ভিন্ন :) আমি চেষ্টা করি এ সময়ের রুটিনটা মেনে চলতে এবং আঁকড়ে ধরে থাকতে! ;)
কিছু পূর্ব পরিকল্পিত কাজের মাধ্যমে দিন শুরু করলে হয়তো আপনার জন্য তা সুফল বয়ে আনতে পারে। নিচে আমি একজন ‘আদর্শ’ কর্মতৎপর মুসলিমের একটি সকালবেলার রুটিন বর্ণনা করেছি। (উল্লেখ্য, আমি ধরে নিয়েছি ফজরের আযান হয় ভোর পাঁচটায় এবং দিনের কর্মতৎপরতা শুরু হয় সকাল আটটায়, আপনি আপনার স্থানীয় সময়ের সাথে মিলিয়ে নিবেন ইনশা আল্লাহ)।
ভোর ০৪.০০ টা – ভোর ০৫.০০ টাঃ পাঁচটি অপরিহার্য কাজ
১. জেগে উঠুন!
সম্ভবত একটি ভালো সকালবেলার রুটিনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা। আর এটা সেই সংশয়পূর্ণ মুহূর্ত – যখন আপনাকে হয় সাথে সাথেই উঠে পড়তে হবে নতুবা ‘আরো ৫ মিনিট’ নরম বিছানার উষ্ণতা উপভোগের জন্য শুয়ে থাকতে হবে – মূলত এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আপনার দিনটি ভালো যাবে নাকি অগোছালো হবে। জেগে ওঠার ক্ষেত্রে এই কৌশলটি আমার ক্ষেত্রে সব সময় কাজ করেঃ আপনি জানেন শয়তান আপনার কানে কীভাবে ফিসফিসিয়ে বলে “আর মাত্র পাঁচ মিনিট ঘুমাও” — প্রতি উত্তরে আমিও নিজেকে ফিসিফিসিয়ে বলি “মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য জেগে ওঠো” ;) আর হ্যাঁ বাকিটা আপনি নিজেই কল্পনা করে নিন। আপনি যখন জেগে উঠে জিকির ও উযু করবেন তখন ঘুমের কী হবে আপনি নিজেই আন্দাজ করতে পারেন – (একেবারে বাড়ি ছেড়ে পালাবে!)।
২. ঘুম থেকে জেগে উঠার দু’আ করুন এবং সূরা আল-ইমরানের শেষ ১০ আয়াত তিলাওয়াত করুন
আলহামদুলিল্লাহ, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কিছু সুন্দর ‘জেগে ওঠার’ দু’আ শিখিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের একটি সংগ্রহ পাওয়া যাবে MakeDua.com ওয়েবসাইটটিতে। সূরা আল-ইমরানের শেষ ১০ আয়াতের তিলাওয়াত আমার খুব প্রিয়। আপনি অনুভব করতে পারবেন আপনার হৃদয় জীবন্ত হয়ে উঠছে এবং এতে ‘প্রাণরস’-এর সঞ্চার হচ্ছে যখন জেগে ওঠার পর আপনার প্রথম কাজ হবে আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর মহান গ্রন্থ থেকে তিলাওয়াত।
৩. উযু করুন
আমরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত হতে পারি যে, উযুর মধ্যে এমন একটি ব্যাপার রয়েছে যা আপনার ইতিবাচক শক্তির প্রতি গুরুত্বারোপ করে এবং আপনাকে পরিচ্ছন্ন করে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে। আমার এক বন্ধু ছিলো যে এই অনুভুতিটির নাম দিয়েছিলো “WuBuzz!” উযু করার পর মনের ভেতর যে “গুঞ্জন” (Buzz) তৈরি হয় তার সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ;) উযুর শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং উযুর শেষে দু’আ করতে ভুলবেন না! এতে জান্নাতের ৮টি দরজা আপনার জন্য খুলে যাবে (দিনের শুরু হিসেবে খুব খারাপ নয় ;) আর আপনি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবেন এবং বাকি দিনের জন্য তৈরি হতে পারবেন।
৪. তাহাজ্জুদ ও বিতরের সালাত
তাহাজ্জুদ বা কিয়ামকে “মুমিনের সম্মান” বলা হয়, কারণ আপনার মতো আর কয়জনই বা এই মাত্র আপনি যা কিছু করলেন (জেগে ওঠা, উযু করা…ইত্যাদি) তা করে সালাতে দাঁড়ায়? তাহাজ্জুদ সালাতের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা কঠিন; হৃদয়ের প্রশান্তি থেকে শুরু করে কুর’আনকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারা, অন্য সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করা এবং সারাক্ষণ সিজদায় পড়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্লেষণের এমন মুহূর্ত আমাদের ব্যস্ত পৃথিবীতে পাওয়া খুবই দুষ্কর…আর এগুলোর পাশাপাশি আরো অনেক কিছুই পাওয়া যায় তাহাজ্জুদ সালাত থেকে। সবশেষে তাহাজ্জুদের পর বিতর সালাত আদায় করা এবং আল্লাহর কাছে আন্তরিক দু’আ করা যা দিন শুরু করার একটি অসাধারণ উপায়!
৫. ইস্তিগফারের মুহূর্ত
ফজরের ৫-১০ মিনিট আগে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং প্রচুর ইস্তিগফার করা যার ফলে আপনি তাদের মধ্যে গণ্য হবেন যাদের কথা আল্লাহ কুর’আনে উল্লেখ করেছেনঃ “রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করত” (কুর’আন, সূরা ৫১, আয়াত ১৮)
ভোর ০৫.০০ টা – ভোর ০৫.০৫ টাঃ ফজরের আযান
মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে তিনি যা বলেন আপনিও তা-ই বলুন, আর আযানের পর দু’আ করতে ভুলবেন না যেনো। আযান সম্পর্কিত দু’আগুলো পাওয়া যাবে MakeDua.com ওয়েবসাইটটিতে।
ভোর ০৫.০৫ টা – ভোর ০৫.৩০ টাঃ আযান ও ইকামাহ্র মধ্যবর্তী সময়
১. ফজরের ২ রাকা’আত সুন্নাহ সালাত আদায় করুন
কোনোভাবেই এটা মিস করবেন না! নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন, “ফজরের দু রাকা’আত দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম।”(রিয়াদুস সালেহীন, হাদীস# ১১০২)। এক মুহূর্তের জন্য এই হাদীসটির কথা চিন্তা করুন; ২ রাকা’আত সালাত আদায় করতে যে ৫ মিনিট সময় লাগে তা দুনিয়া ও এর সমস্ত জায়গা, মানুষ, সম্পদ ও প্রকৃতির চাইতেও উত্তম। সুবহান আল্লাহ!
আর, ফজরের সুন্নাহ সালাতের গুরুত্বই যদি এমন হয় তাহলে একবার ভেবে দেখুন ফরয সালাতের গুরুত্ব কেমন? (যারা ফজরের সালাতকে অবহেলা করে তাদের জন্য ‘আপনি কী ফজরের সালাতকে অবহেলা করছেন?’ নামে একটি অসাধারণ ভিডিও আছে।)
২. দু’আ
আপনি এটা জানেন কী, আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময় যে দু’আ করার একটি মৌলিক সময়? এর সর্বোত্তম ব্যবহারের চেষ্টা করুন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলু্ল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ের দু’আ প্রত্যাখ্যাত হয় না অর্থাৎ কবুল হয়।” (সুনান আবু দাউদ, বই #২, হাদীস # ০৫২১)।
৩. ডানদিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকুন
আ’ঈশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যখন মুয়াজ্জ্বীন ফজরের সালাত এর প্রথম আযান শেষ করতেন তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে যেতেন এবং সুবহে সা’দিকের পর ফজরের সালাত এর আগে দু’রাকাআত সালাত সংক্ষেপে আদায় করতেন, তারপর ডান কাতে শুয়ে পড়তেন এবং ইকামতের জন্য মুয়াজ্জ্বীন তার কাছে না আসা পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন।” (সহীহ বুখারী, বই #১১, হাদীস #৫১১)।
৪. ব্রেইনস্টোর্ম/চিন্তার সময়
মাঝে মাঝে এই সময়টা আমি দিনের কর্মসূচী তৈরিতে ব্যয় করি অথবা ProductiveMuslim এর জন্য আর্টিকেল এর বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করি কিংবা কেবল পড়াশুনা বা লেখালেখি করি। এই সময়ে আপনার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা দেখে আপনি অবাক হবেন! আপনি জাগ্রত, সচেতন এবং সবকিছু একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছেন ;)
৫. কুর’আন হিফয/মুখস্থ করুন
এই সময় আপনার মস্তিষ্ক কর্মক্ষম থাকায় তা কুর’আন মুখস্থ করার জন্য একটি অসাধারণ সময়। আসর/মাগরীবের পর কাজ শেষে কুর’আন মুখস্থ করার সাথে আমি ফজরের পর মুখস্থ করার তুলনা করেছি। সুবহান আল্লাহ! পার্থক্যটি চমক লাগানোর মতো! ফজরের পর আপনার মস্তিষ্ক অনেকটা স্পঞ্জের মতো হয়ে যায়, আর এটাই কুর’আন মুখস্থ করার সর্বোত্তম সময় :)
ভোর ০৫.৩০ টা – ভোর ০৬.০০ টাঃ ফজরের সালাত ও যিক্র
আপনি যদি পুরুষ ভাই হয়ে থাকেন, আর দূরত্ব যতোই হোক না কেন মসজিদে যেতে যান – তবে তাই করুন! মসজিদে গিয়ে ফজরের সালাত আদায় করার সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা কঠিন। গাড়িতে করে মসজিদে যাওয়ার চাইতে আমি হেঁটে যাওয়াটাকেই উত্তম মনে করি (সাইকেল চালিয়েও যেতে পারেন), কারণ এতে আপনি সকালের মুক্ত বাতাসে প্রাণ খুলে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পাবেন; আল্লাহ কুর’আনে বলেনঃ “শপথ প্রভাতের যা অন্ধকার দূর করে দেয়,”[সূরা ৮১, আয়াত ১৮]
ফজরের সালাতের পর বসুন, বিশ্রাম নিন এবং সালাতের পরের যিক্র ও সকালের দু’আগুলো পড়ুন।
ভোর ০৬.০০ টা – ভোর ০৬.৩০ টাঃ তিলাওয়াত, পড়া ও ব্যায়াম করা
১. কুর’আন হিফ্য/তিলাওয়াত
আগে যেমনটি বলেছি, কুর’আন তিলাওয়াত এবং/অথবা মুখস্থ করুন, আর যদি কোনো ভালো তাফসীর গ্রন্থ থাকে তবে প্রতিদিন কমপক্ষে এক পৃষ্ঠা করে কুর’আনের অনুবাদ পাঠ করা একটি বাড়তি পাওনা।
২. পড়াশুনা করা
এই সময়টা ইসলামিক পড়াশুনায় কাটাতে পারেন। আমি ইসলামিক পড়াশুনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ আগেই বলেছি এই সময়টাতে আপনার মস্তিষ্ক একটা স্পঞ্জের মতো হয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে বেশী কার্যকর থাকে। আপনার চাওয়া উচিত যাই পড়ুন না কেন ইনশা আল্লাহ তা যেনো আপনার মন ও মস্তিষ্কে ভালোভাবে গেঁথে যায়।
৩. ব্যায়াম করা
আরেকটি কাজ হতে পারে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা। হতে পারে তা দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, ট্রেডমিল ব্যবহার করা, কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম কিংবা অন্য যেকোনো কিছু যা আপনার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
ভোর ০৬.৩০ টা – ভোর ০৬.৪৫ টাঃ দিনের কর্মসূচী তৈরি করুন
এই সময়টাতেই আমি আমার দিনের কর্মসূচী তৈরি করি, আর অবশ্যই তা রুটিন (Taskinator) ব্যবহার করে :) কখনো কখনো এ সময়টাতে আমি আমার ই-মেইল চেক করি এবং সেগুলোর উত্তর পাঠাই আমার দিনের কর্মসূচীকে সফল করার জন্য, কিংবা নিজের অথবা আমার দলের সদস্যদের জন্য করণীয় ঠিক করি।
ভোর ০৬.৪৫ টা – ভোর ০৭.০০ টাঃ কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হোন
গোসল করুন, জামা-কাপড় পড়ুন এবং সকল কাগজ-পত্র গুছিয়ে নিন (যদিও আগের রাতে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র গুছিয়ে রাখলে ১৫ মিনিটে তৈরি হওয়ার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়!) সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় এমন জায়গায় জিনিস-পত্রগুলো রাখুন, ফলে পরবর্তীতে খোঁজাখুজিতে আর সময় নষ্ট হবে না।
ভোর ০৭.০০ টা – ভোর ০৭.১০ টাঃ দুহা সালাত
“দৈনিক ৭ টি আধ্যাত্মিক ফলদায়ক অভ্যাস” এ যেমনটি বলা হয়েছে, দুহা সালাতের মতো অন্য কোনো কিছুই আপনার দিনের শুরুটা অতো সহজ করে দেয় না। নু’আইম ইবনে হাম্মার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেনঃ হে বনী আদম! তোমরা দিনের প্রথমাংশে চার রাকা’আত নামায আদায় করতে অবহেলা কর না এবং আমি দিনের শেষ ভাগ পর্যন্ত তোমাদের জন্য যথেষ্ট হব। [আবু দাউদ (১২৮৯), আত-তিরমিযী (৪৭৫)]
ভোর ০৭.১৫ টা – ভোর ০৭.৩০ টাঃ সকালের নাস্তা
একটি কর্মতৎপর সকালের জন্য নিজেকে একটি ভারী ও প্রিয় নাস্তা দিয়ে পুরষ্কৃত করুন! ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন এবং নিজের ভালো অবস্থানের জন্য বাটি ভর্তি আঁশ জাতীয় খাবার গ্রহণ করুন।
ভোর ০৭.৩০ টা – ভোর ০৮.০০ টাঃ অফিসের জন্য যাত্রা করুন
আমার লেখা “কর্মতৎপর মুসলিমের যাতায়ত স্টাইল” এর টিপ্সগুলোর কথা ভুলবেন না কিন্তু ;)
কল্পনা করুন, আপনার প্রতিদিনের সকালের রুটিন যদি উপরের বর্ণনার মতো হতো…তবে কতো বেশি আধ্যাত্মিকতা অর্জিত হতো? কতো বেশি জ্ঞান আপনি অর্জন করতেন? দিনের বাকী সময়ের জন্য আপনার মুড কেমন হতো? উপরের কাজগুলো কমপক্ষে একদিন করার চেষ্টা করুন, তারপর ইনশা আল্লাহ আমাকে জানাবেন কেমন লাগলো ইনশাআল্লাহ।
সূত্রঃ ProductiveMuslim.com