দ্বিতীয় পর্বঃ বাংলার মুসলিম জাগরণে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব
আফগানীর প্রভাবে বিভিন্ন আঞ্জুমান ও সংগঠনের জন্ম:
মুসলিম জাগরণের লক্ষ্যে এই সময় সাংবাদিকতা ও সাহিত্য আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন ও আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার বিশেষ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। ১৮৮৩ সালে মহম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহমদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী’। ১৮৯৩ সাল ‘কলিকাতা মহামেডান ইউনিয়ন’। ১৮৯৪ সালে কায়েম করা হয় ‘মহামেডান এলগিন স্পোর্টিং ক্লাব’। ১৮৯৬ সালে ‘মহামেডান রিফর্ম ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৯ সালে মহামেডান ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাব’ স্থাপিত হয়। একই বছর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে সভাপতি ও শেখ আবদুর রহীমকে সম্পাদক করে গড়ে ওঠে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য বিবরণী মুসলমান সমিতি’। ১৯০১ সালে এটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ নামে পরিচিত হয়। ১৯০২ সালে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে কোলকাতায় ‘মুসলিম ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় মুসলিম সমাজ কর্ম, বুদ্ধিজীবী ও তরুণ কর্মীদের মাঝে সভা-সমিতির ধুম পড়ে যায়। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় ইসলাম মিশন সমিতি’। ১৯০৫ সালে মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রতিষ্ঠা করেন "আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা"। তিনি ‘শাহজাহান কোম্পানী’ নামে এ সময় একটি পাবলিক লাইব্রেরী কায়েম করেন এবং খেলাফত আন্দোলনের আর্থিক সহায়তার জন্য ‘খেলাফত ষ্টোর’ নামে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কোলকাতার সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সন্তান আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৩ সালে লন্ডনে “প্যান ইসলামিক সোসইটি অব লন্ডন” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘প্যান ইসলাম’ নামে একটি জার্নালও প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্র ভূমি থেকে প্রকাশিত ‘প্যান ইসলাম’ জার্নালের মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মুকাবিলায় তিনি ইসলামী সংস্কৃতির গৌরব এবং সভ্যতার উত্থানের পক্ষে কাজ করেন। ‘প্যান ইসলাম সোসাইটি’ ১৯০৫ সালে আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর সংকলিত The Sayings of Muhammad (s) নামে রাসুল (সঃ) এর বাণীর একটি সংকলন প্রকাশ করে। বইটি পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মধ্যে এতখানি প্রভাব ফেলে যে, বিশ্ব বিখ্যাত সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের মৃত্যুর পর তার ওভার কোটের পকেটে এই বইয়ের একটি কপি পাওয়া যায়।
কুড়ি শতকের রাজনীতির মোড় পরিবর্তনের আফগানীর প্রভাব:
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে আজকের মুসলিম মেজরিটি অধ্যুষিত ‘পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ’ গঠনের ফলে বাংলার মুসলিম জাগরণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। জামাল উদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামী স্বাতন্ত্র্য-চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এই ইতিবাচক প্রশাসনিক পরিবর্তনকে বাংলার জনগণের উন্নতির সোপান রূপে কাজে লাগাতে ব্যাপৃত হন। কিন্তু বর্ণহিন্দু জমিদার-উকিল-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রভৃতি গোষ্ঠির সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের মুখে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গ-বিভাগ রদ করা হয়।
বঙ্গবিভাগ রদের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে যে প্রতিবাদ ওঠে, সে ক্ষেত্রে সবচে’ সোচ্চার ছিলেন জামাল উদ্দীন আফগানীর আদর্শিক ভাবধারার উদ্বুদ্ধ প্যান ইসলামী ভাবধারার রাজনৈতিক কর্মীগণ। বঙ্গবিভাগ রদ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্যান ইসলামী নেতা আবদুল্লাহ সোহরাওয়াদী বলেনঃ “If we are silent and less vocal, our silence is silence of anger and sorrow and not that of acquiescence. In proportion to our devotion to the person on Throne of His Majesty is the intensity of our resentment at the cowardly device of pulling the announcement in the mouth of the King Emperor and thus muzzling us effectively”. (Matiur Rahman: From Consultation to Confrontation. P-219; মোহাম্মদ আবদুল মান্নান: আমাদের জাতি সত্তার বিকাশধারা, পৃঃ ১৪৪-১৪৫)
বঙ্গবিভাগের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তাৎপর্যকে ধারণ করার জন্য ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের ১৯১০ সালের নাগপুর অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে “আত্মনিরর্ভরশীলতা” বা Self Reliance অর্জনের দলীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবিভাগ রদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্যান ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘স্বাধিকার আদায়ের’ সংকল্প জোরদার হয়ে ওঠে। প্যান ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ তরুণ নেতাদের প্রভাবেই ১৯১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাঁকিপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সদ্য প্রণীত গঠনতন্ত্রে স্বায়ত্ত্ব শাসনের (Self Government) দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯১৩ সালের ২২ মার্চ মুসলিম লীগের লাখনৌ অধিবেশনে তা অনুমোদিত হয়। এভাবেই বঙ্গবিভাগ রদের প্রতিক্রিয়ার পথ ধরে মুসলিম বঙ্গ ও মুসলিম ভারতের রাজনীতি স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীর আপোষকামী আবেদন-নিবেদন মূলক ধারা অতিক্রম করে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তরুণ মুসলিম নেতৃত্বের অধীনে ‘সক্রিয় রাজনীতি’তে পদার্পণ করে। ১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিলে কোলকাতায় ব্যবস্থাপক সভার বাজেট বক্তৃতায় নওয়াব সলীমুল্লাহর রাজনৈতিক মানসপুত্র আবুল কাশেম ফজলুল হক পূর্বসূরীদের ‘আবেদন নিবেদন ও করজোড় নীতি’ অতিক্রম করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেন, মুসলমানদের দাবি-দাওয়া পূরণে বার বার ব্যর্থ হলে ইংরেজ রাজশক্তিকে এজন্য খেসারত দিতে হবে। (J.H. Broomfield: Elite Conflict, P-64)
বাংলাদেশ সহ সর্বভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় রাজনৈতিক চিন্তা ১৮৭০ সাল থেকেই আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় আপ্লুত হয়। ফলে জিহাদপন্থী ও ফরায়েজী পন্থীদের বিপ্লবী ধারা, স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীর আপোষকামী ধারা এবং কেরামত আলী জৈনপুরীর চিন্তাধারার মাঝে দূরত্ব কমে আসে। আফগানীর প্রভাবে বাংলার মুসলিম জাগরণের ঊষাকাল থেকেই মুসলিম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ সকলেই যুক্তভাবে কিংবা মুক্ত ভাবে প্যান ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা হিসাবে ভূমিকা পালন করেন।
হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমদের স্বাতন্ত্রবাদী চিন্তা জিহাদপন্থী ও ফরায়েজী পন্থীদের বিপরীতে ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু আফগানীর প্যান ইসলামী চিন্তা ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের এই নীতিকে প্রবল ভাবে আঘাত হানে। ভারতীয় মুসলমানদের উম্মাহ চেতনা এবং উসমানীয় খিলাফতের প্রতি সহানুভূতি আফগানীর সংস্পর্শে এসে বহু গুণে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্যার সৈয়দের আপোষনীতির বিপরীতে আফগানী দৃঢ় ভাবে মনে করতেন যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে আপোষের কোন সম্ভাবনা নেই; বরং চূড়ান্ত পর্যায়ে সংঘাত অনিবার্য। আফগানী তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের অনেককেই এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আফগানী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহবান প্রচারের সাথে সাথে উম্মাহর কুরআন কেন্দ্রিক ঐক্য ও আদর্শিক সংহতির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সামাজিক ব্যবস্থায় ইসলামকে অনুসরণ করার জন্য তিনি তাঁদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করেন, উত্তরণের পথ প্রদর্শন করেন এবং এক্ষেত্রে জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বকে তাঁদের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে কর্মতৎপর হতে তাগিদ প্রদান করেন। বাংলা সহ মুসলিম ভারতে ঊনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে আফগানীর প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং কুঁড়ি শতকের সূচনায় এসে আফগানী তাদের ঐক্য চেতনা ও জাগরণ প্রয়াসের প্রতীকে পরিণত হন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তানায়ক আল্লামা শিবলী নু’মানী (১৮৭৫-১৯১৪) ১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত খিলাফত প্রশ্নে স্যার সৈয়দ আহমদের এই ধারণার সাথে একমত ছিলেন যে, প্রকৃত খিলাফতের ব্যাপারটি শুধু খোলাফায়ে রাশেদার সাথেই সম্পর্কযুক্ত। তিনি ১৮৯৩ সালে কায়রোতে আফগানীর ঘনিষ্ঠ সাথী ও ভাবশিষ্য শায়খ মুহাম্মদ আবদুহুর সাথে সাক্ষাত করেন। এরপর শিবলী নু’মানীর চিন্তাধারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
মুসলমানগণ ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক ও অভিন্ন, এই চিন্তা দেশে দেশে ছড়িয়ে দিয়ে আফগানী মুসলমানদের মাঝে এক নতুন স্বপ্ন ও আকাংখাকে জাগিয়ে তোলেন। উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন, স্বাধিকার-স্বাতন্ত্রের লড়াই, পরিণতিতে স্বতন্ত্র আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলমানদের ত্যাগ ও কুরবানীর পথে পরিচালিত করতে আফগানীর প্যান ইসলামী চিন্তা বিশেষ অবদান রাখে।
সূত্রঃ দি পাইওনিয়ার প্রকাশিত “জামাল উদ্দীন আফগানী: নবপ্রভাতের সূর্যপুরুষ” গ্রন্থ
প্রথম পর্বঃ বাংলার মুসলিম জাগরণে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব