মুন্সী মেহেরুল্লাহ্ এবং সে সময়কার পরিপ্রেক্ষিত
৬৪৬ বার পঠিত
ইকবালের কবিতা
৬৫৫ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ইতিহাসবেত্তা ও শিল্প সচেতন ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ২২ মার্চ যশোর জেলার মাগুরার (বর্তমান জেলা) আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বরেণ্য তাপস হযরত শাহ আলী বোগদাদীর বংশধর। সৈয়দ আলী আহসানের পূর্ব পুরুষেরা অনেকেই ধর্মপ্রাণ ও জ্ঞানবান মনীষী ছিলেন।
সৈয়দ আলী আহসানের শিক্ষা জীবনের শুরু ঢাকার ধামরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রকৃত পাঠচর্চা চলতে থাকে গৃহাঙ্গনে। গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ফারসী, ইংরেজী, বাংলা ও গণিত শাস্ত্রে পাঠ গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৪০ সালে সৈয়দ আলী আহসানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী -ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন।
তাঁর কর্মজীবন হুগলী ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক (১৯৪৫) হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর প্রোগ্রাম এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে অল-ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকা রেডিও (১৯৪৭)। ১৯৪৯ সালে সাহিত্য কর্মের খ্যাতির জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আন্তর্জাতিক পি. ই. এন. পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারী জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ আলী আহসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি "চেনাকণ্ঠ" ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়েগ পান। সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে অভিষিক্ত হন এবং সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শেষ বয়সে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
আর্মানিটোলা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৩৭ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম একটি ইংরেজী কবিতা "The rose" প্রথম মুদ্রিত হয়। কবি মতিউল ইসলাম এ কবিতাটি বাঙলায় অনুবাদ করে ‘চাবুক’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ম্যাট্রিক পড়ার সময় ‘আজাদ’ পত্রিকায় তাঁর দু’টি লেখা প্রকাশিত হয়। একটির শিরোনাম ‘হিন্দু-মুসলিম সমস্যা’ এবং অন্যটি ‘গণতন্ত্র ও ডিকটেটরশীপ।’
এই তরুণ বয়সেই সাহিত্য কর্মের জন্যে তৎকালীন বাংলা ভাষার খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। এ সকল কবি সাহিত্যিকের মধ্যে কবি ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবুজাফর, শওকত ওসমান, বেগম সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে পড়ার সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় এবং কথা বলার অসাধারণ কলাকৌশলের জন্যে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তিনি ‘প্রগতি সাহিত্য সংসদ’ ও রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পাটি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯৪০ থেকে ৪৪ এর মধ্যে তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন। ‘মাসিক মোহাম্মদী’ এবং ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। ‘বুদ্বুদ’, ‘তারা তিনজন’, ‘রহিমা’, ‘জন্মদিনে’ গল্পগুলি তাঁর অন্যতম। এ সময় তিনি ‘ইহাই স্বাভাবিক নামে একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে গল্পচর্চা ছেড়ে শুরু করেন কবিতা চর্চা।
সমালোচক হিসেবে তাঁর পদার্পণ ঘটে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকায়, কবি সত্যেন্দ্রনাথ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি মুদ্রিত হবার পর। এ সময়ে লেখা ‘রোহিনী’, ‘কবিতার বিষয়বস্তু’ ও ‘কালি কলমের প্রথম বর্ষ’ প্রবন্ধ তিনটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় ১৯৫০ সালে শাহাদৎ হোসেনের কাব্য সংকলন ‘রূপছন্দা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন- এ সময় তিনি ‘ইকবালের কবিতা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৫৩ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলস্নাহর সহযোগে ‘গল্পসঞ্চয়ন’ নামে একটি গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৫৪ সালে ‘নজরুল ইসলাম’ নামক একটি সমালোচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৫৬ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই এর সহযোগিতায় ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি রচনা করেন। করাচী থাকাকালীন ‘কবি মধুসূদন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
সৈয়দ আলী আহসানের প্রতিভা বিভিন্নমুখী। প্রবন্ধলেখা ও সমালোচনায় তাঁর কৃতিত্ব তুলনাহীন। ‘কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা’ গ্রন্থে অসাধারণ দক্ষতায় প্রবন্ধ ও সমালোচনাকে তিনি সৃষ্টিশীল করে তুলেছেন।
তাঁর ‘অনেক আকাশ’, ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’, ‘সহসা সচকিত’ এবং ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থগুলো ঐতিহ্যানুরাগী সৌন্দর্যবোধ ও দেশপ্রীতির অনুপম নিদর্শন।
সৈয়দ আলী আহসানের চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং অন্যান্য চারুকলার প্রতি আগ্রহ অপরিসীম। চিত্রকলার ইতিহাস ও চিত্রশিল্পের রসাস্বাদনে তিনি একজন নিবেদিত প্রাণ। চিত্রকলার অধ্যাপনায় তাঁর সাফল্য বিশেষ স্মরণীয়। ১৯৭০ সালে তাঁর ‘আধুনিক বাংলা কবিতাঃ শব্দের অনুষঙ্গে’ প্রকাশিত হয়।
১৯৭৩ সালে তাঁর সম্পাদিত মধ্যযুগের কাব্য ‘মধুমালতি’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থেও তাঁর পান্ডিত্যের পরিচয় রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ‘রবীন্দ্রনাথঃ কাব্য বিচারে ভূমিকা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে ‘জার্মান সাহিত্য; একটি নিদর্শন’ প্রকাশিত হয়।
১৯৮২ সালে "Approach" নামে একটি ইংরেজী ষান্মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর ‘আধুনিক কাব্য চৈতন্য এবং মোহাম্মদ মানিরুজ্জামানের কবিতা’ শীর্ষক গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়।
এই জ্ঞানতাপস সৈয়দ আলী আহসান ২০০২ সালের ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমন্ডির কলাবাগানস্থ নিজ বাসভবনে পরলোক গমন করেন।