বাংলার মুসলিম জাগরণে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব (পর্ব-২)

প্রথম পর্বঃ বাংলার মুসলিম জাগরণে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব

বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতায় আফগানীর প্রভাব:

গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া লিখেছেন: প্রকৃত পক্ষে ১৮৭৭ সালে ‘মহম্মদী আখবার’ প্রকাশের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক তাদের আত্মপরিচয় ও  অবস্থান জানাবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এই পত্র-পত্রিকাগুলোর অধিকাংশ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এবং ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা প্রকাশ এগুলোর প্রধান উপজীব্য ছিল।...তুর্কি খিলাফত এবং জামাল উদ্দিন আফগানীর মতবাদ ভারতীয় তথা বাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের প্যান ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত করে। বাংলার অনেক শিক্ষিত লোক কর্তৃক সাময়িকপত্র প্রকাশের মূলে এই চেতনা সক্রিয় ছিল। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ‘মহম্মদী আখবার’ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল অবধি সময়ে প্রকাশিত পত্রিকার নামকরণ ও সম্পাদকীয় উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করলে আমাদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। কারণ অধিকাংশ সাময়িকপত্রেরই নাম মুখ্যত ‘ইসলাম’ আর ‘মুসলিম’ এই দুই বিশেষ শব্দ বাঞ্ছিত।’ (গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া: মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, পৃষ্ঠা ৯৬-১০১, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫)

আফগানীর কোলকাতা আগমনের পর ১৮৮৪ সাল থেকে মুসলিম সম্পাদিত সংবাদ সাময়িকপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৮৮৪ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত ষোল বছরে এখানে ১৬টি, ১৯০০ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত নয় বছরে ১৫টি এবং ১৯১১ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এগারো বছরে ৩০টি মুসলিম সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়।

জামাল উদ্দীন আফগানীর কোলকাতা সফরের আগে বাঙ্গালি মুসলমান সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্রের সন্ধান বড় একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আফগানীর কোলকাতা সফরের পর ১৯০৩ সালের মধ্যেই জাগরণকামী মুসলিম সম্পাদিত ৩০টিরও বেশী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্যারিস থেকে আফগানী কর্তৃক ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ প্রকাশের একই বছর ১৮৮৪ সালে মোহাম্মদ নইমুদ্দীনের সম্পাদনায় ‘আখবারের এসলামিয়া’, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘মুসলমান’ ও ‘মুসলমান বন্ধু’ প্রকাশিত হয়। এরপর একিনউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘ইসলাম’ (১৮৮৫), মোঃ রেয়াজউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘নব সুধাকর’ (১৮৮৬), গোলাম কাদের-এর সম্পাদনায় ‘হিন্দু মুসলমান সম্মিলনী’ (১৮৮৭) প্রকাশিত হয়। করটিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আখবারে এসলামিয়া’ ছাড়া সব ক’টি পত্রিকাই প্রকাশিত হয় কোলকাতা থেকে। বলা চলে, বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার এটাই ছিল সূচনা পর্ব। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘সুধাকর’ থেকে এক্ষেত্রে একটি অপেক্ষাকৃত সক্রিয় ও সম্পন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়।

‘সুধাকর’ প্রকাশ প্রসঙ্গে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেনঃ “বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়, যাদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সমাজ-প্রাণ ও সাহিত্যিক গোষ্ঠি হচ্ছেনঃ মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রেয়াজ উদ্দীন মাশহাদী, মৌলভী মেরাজ উদ্দীন, মুন্সি মোহাম্মদ মেহের উল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম এবং শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক। বাংলার মুসলমানদের দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অভিযোগ এদের প্রাণে একটা তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। এরা বুঝতে পারেন, বাংলার মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করার জন্য চাই তার একটা বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক মুখপত্র। এদেরই চেষ্টায় ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হয়। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ এই সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক পদে বরিত হন।” (দৃষ্টিকোণ, পৃঃ ১৬৯)

১৮৮৯ সালে সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হবার পর ১৮৯০ সালে মীর মোশারফ হোসেন প্রকাশ করেন পাক্ষিক ‘হিতকরী’। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইসলাম প্রচারক’, ১৮৯২ সালে ‘মিহির’ ও ‘হাফেজ’। ১৮৯৪ সালে শেখ আবদুর রহীমের ‘মিহির’ এবং শেখ মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দীন আহমদ-এর ‘সুধাকর’ একত্রিত হয়ে যৌথ সম্পাদনায় ‘মিহির ও সুধাকর’ নামে ১৯১০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৮৯৮ সালে ‘কোহিনুর’, ১৮৯৯ সালে ‘প্রচারক’, ১৯০০ সালে ‘ইসলাম’, ‘নূর অল ঈমান’, ১৯০১ সালে ‘মুসলমান পত্রিকা’ ‘সোলতান’ ও ‘নূরুল ইসলাম’ প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালে ‘নবনূর’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘হানাফি’, ১৯০৬ সালে ‘ইসলাম সুহৃদ’, ১৯০৭ সালে ‘মোসলেম প্রতিভা’, ১৯০৮ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, ১৯১১ সালে ‘মোসলেম হিতৈষী’, ১৯১২ সালে ‘প্রভাকর’ ও ‘হাবলুল মতিন’, ১৯১৩ সালে ‘হাকিম’ ও ‘ইসলাম আভা’, ১৯১৫ সালে ‘আহলে হাদিস’, ‘আল এসলাম’, ‘ইসলাম দর্শন’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র ছাড়া আফগানীর ভাবাদর্শ-প্রভাবিত কয়েকটি ইংরেজী পত্রিকাও এ সময় প্রকাশিত হয়। ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দি মুসলিম ক্রনিকল’ ও ‘দি মুসলমান’-এর সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে এ,আলি ও মুজিবর রহমান। আফগানীর চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত মওলানা মোহাম্মদ আলী (১৮৭৮-১৯৩১) কোলকাতা থেকে ‘দি কমরেড’ (১৯১১) প্রকাশ করেন। তাঁর পত্রিকায় বিশেষ ভাবে প্যান ইসলামী চিন্তাধারা ও মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি গুরুত্ব পায়।

মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) ছিলেন প্যান ইসলাম আন্দোলনের শক্তিশালী ব্যাখ্যাদাতা। আফগানী প্রভাবিত ‘আল-মানার’ গ্রুপের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। তাঁর সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আল হেলাল’ (১৯১২) ও ‘আল বালাগ’ পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন স্থানে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণের মাধ্যমে ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনিও আফগানীর মতোই সৈয়দ আহমদের পাশ্চাত্য প্রীতি ও আপোষ নীতির সমালোচনা করেন।

মুসলিম বাংলার আধুনিক সাংবাদিকতার জনক, ‘আজাদ’ ও ‘মোহাম্মদী’র প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ‘প্যান ইসলামিষ্ট’। তাঁর সম্পর্কে মুজিবর রহমান খাঁ লিখেছেন: ‘মওলানা জামাল উদ্দীন আফগানী তাঁর আদর্শ। তিনি বিশ্বাস করতেন জিহাদ করে মুসলমান বড় হয়েছিল এবং জিহাদের পথ ধরেই তারা আবার বড় হবে- হৃত গৌরব ফিরে পাবে। এ ধরনের নীতি বিশ্বাসের ঘোষণা মওলানা আকরম খাঁর মুখে দিনের পর দিন শুনেছি।” (আবু জাফর সম্পাদিত মওলানা আকরম খাঁ গ্রন্থে প্রকাশিত মুজিবুর রহমান খাঁর প্রবন্ধ, পৃঃ-৯৫)

বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে আফগানীর প্রভাব:

উনিশ শতকের আশির দশক ও কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে অধিকাংশ মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকের ওপর জামাল উদ্দীন আফগানীর আদর্শিক প্রেরণার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মীর মোশারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২)এর শেষ দিককার রচনা ‘মৌলুদ শরীফ’ (১৯০৫), মদীনার গৌরব (১৯০৬), ‘মোশ্লেম বিজয়’ (১৯০৮), ‘ইসলামের জয়’ (১৯০৮) প্রভৃতিতে ইসলামী আন্তর্জাতিকতা ও মুসলিম জাগরণ-প্রয়াসী রূপ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ সময় সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে জাগরণের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসেন আরো অনেকে। তাঁদের মধ্যে রেয়াজ আল দীন মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৪), নজিবর রহমান (১৮৬২-১৯৩৩), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), শেখ আবদুস সোবহান, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৫৯-১৯৫৩), মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৪-১৯৫০), সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৭৬-১৯৫৯), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), শেখ আবদুল জব্বার (১৮৮১-১৯১৮), শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২-১৯৩২), মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০) প্রমুখ অগ্রণী ছিলেন। তাঁরা সকলেই তাঁদের সাহিত্য কর্মে মুসলিম সমাজ-চিত্রের প্রতিফলন, ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমাজ নীতির ব্যাখ্যা প্রদান, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধন এবং গৌরবময় অতীতের আলোকে মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যত সমাজ রচনার আকাংখা তুলে ধরে মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন। এই সময়কার অধিকাংশ লেখকই কোন-না-কোনভাবে আফগানীর চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

এই সকল মুসলিম মনীষীর মধ্যে রেয়াজ আল দীন মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৮) কোলকাতার আলবার্ট হলে আফগানীর বক্তৃতার প্রায় সাত বছর পর ১৮৮৯ সালে ‘সমাজ সংস্কারক’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে আফগানীর চিন্তা-চর্চার গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মাশহাদীর এ গ্রন্থটিতে আফগানীর সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য ও চিন্তা চেতনার বিশ্লেষণ ফুঠে উঠেছে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর (১৮২৪-১৮৮৩) আর্য সমাজ (১৮৭৫) বা শুদ্ধি আন্দোলন ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার যে আগুন ছড়িয়ে দেয় তার প্রতিবাদে মাশহাদী ১৮৮৯ সালে ‘অগ্নিকুক্কুট’ প্রকাশ করেন।

ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১), ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ (১৯১৩), ‘তুর্কী নারী’ (১৯১৩), ‘স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা’ (১৯১৪), ‘স্ত্রী শিক্ষা’ (১৯১৬), ‘সুচিন্তা’ (১৯১৭), প্রভৃতি রচনায় আফগানীর প্রভাব স্পষ্ট। সিরাজী প্যান ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আহলে আহমের’ সদস্য রূপে ১৯১২ সালে তুরস্কে গমন করেন। এই সফর তাঁর চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ত্রিশের দশক পর্যন্ত ইসলামী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ইয়াকুব আলী চৌধুরীও (১৮৮৭-১৯৩৮) প্যান ইসলামী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

উনিশ শতকের শেষ দুই দশক এবং কুড়ি শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্য সাধনা ও ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের যৌথ শোষণ-লুন্ঠন, পিছিয়ে পড়া বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানগণ মূলত এই জাগরণ প্রয়াসের কান্ডারী ছিলেন। তবে এ কাজে কয়েকজন সমাজহিতৈষী বিত্তবান মুসলমান বিশেষ যত্নবান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ছিলেন মোমেনশাহীর ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯)। তাঁর কাছে বাংলার মুসলমানেরা নানাভাবেই ঋণী। বিশেষত মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মিহির ও সুধাকর’ (১৮৯৫) ও ‘প্রচারক’ (১৮৯৯) এর আর্থিক ব্যয় নির্বাহে তিনি সহায়তা করেন। ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকাটি নওয়াব আলী চৌধুরীর স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা ‘আলতাফি প্রেস’ থেকে মুদ্রিত হতো। ‘ইসলাম প্রচারক’ (১৮৯১) তাঁর অবদানের বিশেষ প্রশংসা করেছে।

কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সুধাকর’ ও ‘ইসলাম প্রচারক’ পত্রিকা দু’টিকে অর্থ-সাহায্য করেন নওয়াব ফয়েজুন্নেসা চৌধুরাণী (১৮৩৪-১৯০৪)। এই পত্রিকা দু’টি শিক্ষিত মুসলমান সমাজকে ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবোধে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালায়। কোলকাতার এক শ্রেণীর অভিজাত লোকের মধ্যে বাংলাভাষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে ‘ইসলাম প্রচারক’ বাংলাভাষার পক্ষে আন্দোলন করে এবং কুরআনের তাফসীর ও অন্যান্য ধর্মীয় বইয়ের বাংলা তরজমা প্রকাশ করে ধর্মীয় ভ্রান্তি ও কুসংস্কার দূর করতে ভূমিকা পালন করে।

‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) প্রকাশিত হতো করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলীর ‘মাহমুদিয়া প্রেস’ থেকে। ‘সোলতান’ (১৯০১) প্রকাশে আর্থিক সহায়তা করেন রংপুরের জমিদার ও কোলকাতার সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের রংপুর শাখার সভাপতি খান বাহাদুর আবদুল মজিদ। টাঙ্গাইল থেকে আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ীর সম্পাদনায় ১৮৮৫ সালে মাসিক ও ১৮৮৬ সালে পাক্ষিক ‘আহমদী’ প্রকাশিত হয় করিমুন্নেছা খানমের অর্থানুকূল্যে। ১৮৯০ সালে মীর মোশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে পাক্ষিক ‘হিতকরী’ প্রকাশিত হয় টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহায়তায়। “খৃষ্ট, ব্রহ্ম ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব থেকে ইসলাম ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষাই” ছিল এই পত্রিকার ঘোষিত লক্ষ্য। এসব পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।

অধঃপতিত মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন তথা বাংলার মুসলমানদের নব জাগরণই ছিল এ সময়কার সকল পত্র-পত্রিকার মূল কথা। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে প্যান ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকা। সাধারণভাবে মুসলমানদের মাঝে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রচার, ইসলামী আন্তর্জাতিক বা উন্মাহ ধারণার প্রচার, তুর্কী খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি ছিল এসব পত্র-পত্রিকার উপজীব্য। ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম অবদানের মহিমা প্রচার, ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের প্রচার-মাধ্যমে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবমূল্যায়ণ করে প্রকাশিত রচনাবলীর জবাব দান, মুসলিম সমাজের দুর্বলতাগুলি চিহ্নিত করে তাঁর প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান, শিরক-বিদাত, কুসংস্কার দূর করে শরীয়তের অনুশাসনের ভিত্তিতে সকল প্রকার আলস্য ও জড়তা কাটিয়ে নতুন হিম্মতে জেগে ওঠার আহবান প্রচার প্রভৃতি বিষয় ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার বৈশিষ্ট্য। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং নিজস্ব তাহজিব-তমদ্দুনের বিকাশ সাধন ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার লক্ষ্য। এমনকি, ‘শিক্ষা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘জয়তী’ প্রভৃতি পত্রিকার অন্তরের বাণী ও ছিল মুসলিম সংস্কৃতি ভিত্তিক স্বাতস্ত্র-চেতনা। তাদের বক্তব্যও ছিল ইসলামের সাথে সঙ্গতি-সন্ধানে প্রয়াসী।

সূত্রঃ দি পাইওনিয়ার প্রকাশিত “জামাল উদ্দীন আফগানী: নবপ্রভাতের সূর্যপুরুষ” গ্রন্থ

তৃত্বীয় পর্বঃ বাংলার মুসলিম জাগরণে জামাল উদ্দীন আফগানীর প্রভাব