জুলাই বিপ্লব, সেকুলার রাজনীতি এবং মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্ত্বা

[৩১শে আগস্ট ২০২৪ সালে Ummahtics আয়োজিত “Bangladesh’s Revolution: Challenges, Opportunities and the Umma” ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচক ছিলেন জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডেরসাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান এবং ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের এনথ্রোপলজি বিভাগের ভিজিটিং এসিস্ট্যান্টপ্রফেসর ড. তানজীন দোহা। তাঁদের বক্তব্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরসংকট, একাত্তর, শাহবাগ, শাপলা, জুলাই বিপ্লব এবং মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তাসত্ত্বার বিভিন্ন দিকউঠে আসে। সমসাময়িক রাজনীতির প্রেক্ষিতে এসব বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে বাংলা ভাষাভাষীপাঠকদর জন্য এই আলোচনার একটি সারসংক্ষেপ পেশ করা হল।]

মাহমুদুর রহমান

আমি শুরুতেই দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করতে চাই, এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি বোঝারজন্য। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম অঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে চারটিমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ—পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপ। দুটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ—ভারত ও নেপাল এবং দুটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ—শ্রীলঙ্কা ও ভুটান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের প্রস্থানের পরথেকেই ভারত এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টায় ভারতের বিপরীতে সবচেয়েবড় বাধা পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে ভুটান ১৯৪৯ সালে বন্ধুত্ব চুক্তির মাধ্যমেভারতের প্রভাবের অধীনে আসে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ক্লাসিক্যাল গ্রিক আধিপত্যবাদের মতোভুটানের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গেভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ভুটানের পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণভাবে ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাকিছয়টি দেশের মধ্যে, গত পনেরো বছরে ভারত বাংলাদেশে পুতুল সরকার বসিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে তারপ্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছে। 

গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে বিচারবহির্ভূতহত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, আইনবহির্ভূত গ্রেফতার এবং কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। অথচ, একসময় বাংলাদেশ ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশগণতন্ত্রের অল্প কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে একটি ছিল। এ সময়ে তিনটি স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিতহয়, যেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের দল ও নেতা নির্বাচন করতে পেরেছিল। ৯/১১ পরবর্তীবিশ্বে, প্রেসিডেন্ট বুশের “আমাদের সাথে অথবা আমাদের বিপক্ষে” নীতির ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্তহয়। এই নীতির মাধ্যমে আমেরিকান প্রশাসন ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার অঘোষিত মোড়ল হিসেবেস্বীকৃতি দেয়। আমেরিকা ভারতকে চীন এবং “ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের” বিরুদ্ধে কৌশলগত মিত্র হিসেবেঘোষণা করে। এই নীতির সুযোগ নিয়ে ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকারপ্রতিষ্ঠা করে।

২০১৯ সাল পর্যন্ত, ভারতের পুতুল সরকারের অধীনে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্যাতনের বিষয়েপশ্চিমা দেশগুলো নীরব ছিল। এর পেছনে কারণ ছিল, ভারত নিয়মিতভাবে পশ্চিমারাজধানীগুলো, বিশেষত ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং ব্রাসেলসে তাদের ব্রিফিং প্রদান করত। ভারত তারপশ্চিমা মিত্রদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং ইসলামপন্থার উত্থান নিয়ন্ত্রণেরাখতে বাংলাদেশকে তাদের অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে ধরে রাখা প্রয়োজন। এই অবস্থার কারণে বাংলাদেশকেচরমভাবে ভুগতে হয়েছে।

আগস্ট মাসের এই বিপ্লবের আগে মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াই করে গেছে। এইলড়াইয়ে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এক হাজারেরও বেশি মানুষকে জোরপূর্বক অপহরণের শিকারহতে হয়েছে, এবং অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। যখনই সরকারসংকটে পড়ত, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ক্ষমতা ব্যবহার করত। দক্ষিণএশিয়া সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ এটি যে, চীনকে মোকাবিলাকরতে ভারতকে প্রয়োজন, তাই তারা বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদের বিষয়ে নীরব থেকেছে।

এই পরিস্থিতিতে, জুলাই ও আগস্ট মাসে টানা তিন থেকে চার সপ্তাহ ধরে যে অসাধারণ বিপ্লব সংঘটিতহয়েছে, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯শে জুলাই আবু সাঈদের শাহাদাত। সেদিন ছাত্ররাপুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিল, এবং আবু সাঈদ সেই প্রতিবাদে সামিল ছিল। পুলিশের বন্দুকেরসামনে দাঁড়িয়ে সে দুই হাত প্রসারিত করে তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। পুলিশ গুলি শুরু করলে, সেসোজা দাঁড়ানো অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সে আবার উঠে দাঁড়ায়। পুনরায় গুলিবিদ্ধ হয়এবং আবার মাটিতে পড়ে যায়। দুইবার মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও সে আবার উঠে দাঁড়ায়, এইনির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। তবে শেষ পর্যন্ত, সে শহীদ হয়। এটি অনেকটা ২০১০ সালেরতিউনিসিয়ার বুআজিজির আত্মত্যাগের মতো, যা আরব বসন্তের সূচনা করেছিল। তবে আবু সাঈদেরমৃত্যু ছিল আরও বেশি সাহসিকতাপূর্ণ। এটি কোনো আত্মহত্যা ছিল না, বরং সরকারের নৃশংস বাহিনীরসামনে এক নিরস্ত্র চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, এই ছবি একবিংশ শতাব্দীর যে কোনো বিপ্লবের জন্যএকটি আইকনিক প্রতীক হয়ে থাকবে। মুসলিম উম্মাহর জন্য, আবু সাঈদ বিপ্লবের নতুন নায়ক।

এই বিপ্লব কি সফল হতে যাচ্ছে নাকি আরব বসন্তের মতো ব্যর্থ হবে সেটা বুঝার জন্য ভূরাজনীতিরদিকে লক্ষ্য করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন এবং ভারত এই ক্ষতিকেসহজভাবে মেনে নিবে না। হাসিনার পতন এই অঞ্চলের ইতিহাসে ভারতের বিদেশনীতির সবচেয়ে বড়বিপর্যয়। শ্রীলংকাতেও নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তামিল টাইগারদের কাছে পরাজিত হয়ে ভারতীয়সেনাবাহিনীকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছিলো। নেপাল ক্ষুদ্র দেশ হয়েও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে পরাজিতকরেছে। আফগানিস্তানেও আশরাফ গণির পতনের পর আমেরিকানদের পাশাপাশি ভারতীয়দেরকেওআফগানিস্তান ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু ভারত বাংলাদেশে যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশিকৌশলগত বিনিয়োগ করেছে।

বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় এজেন্টের উপস্থিতি বিদ্যমান। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকরে আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করবে। কারণ, যদি বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেস্বাধীন হয়, তাহলে ভারতের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ এমন একটি মার্কেটপ্লেস, যেখানেভারত পণ্য এবং জনশক্তি রপ্তানি করে বিপুল আয় করে থাকে। বাংলাদেশ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তমরেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ ভারতকে এতো টাকা প্রদান করছে এটাঅকল্পনীয়। তাই এটি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য বিশাল ক্ষতি। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে ভারতীয়সামরিক প্রতিষ্ঠান এবং দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে তাদের কৌশলগত নীতির।

বাংলাদেশ সংলগ্ন চিকেন নেক ভারত, চীন ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে যা খুবই সংকীর্ণ করিডোর। বিগত ফ্যাসিস্ট দরকার ভারতকে তথাকথিত ট্রানজিট দিয়েছে- যা মূলত করিডোর। এর মাধ্যমে ভারতবাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের সুযোগ পেয়েছে। ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারযদি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়, তবে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় যানবাহনের চলাচল বন্ধকরতে হবে। ভবিষ্যতে যেকোনো চীনা আক্রমণে এটি ঝুঁকিপূর্ণ।

এই বিপ্লবের সফলতা নির্ভর করছে যথাসময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতাহস্তান্তর এবং সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের উপর। গত ফ্যাসিস্ট সরকার ভারতের সাথে এমনকিছু চুক্তি করেছেযা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধেই নয় বরং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধেও। আমি আশা করি, বর্তমানসরকার ভারতের সাথে হওয়া সব চুক্তি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি বা স্বাধীন কমিশন গঠনকরবে। এটি নির্ভর করছে ক্ষমতায় থাকা সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং রাজনৈতিক সক্ষমতার উপর। ভারতীয় আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তাদের আছে কিনা এবং পতিত সরকার ভারতের সাথেযে চুক্তি করেছে তা যদি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হয়, তাহলে সরকার তা বাতিল করবে কিনা সেটা এইসরকারের জন্য বড় পরীক্ষা। এর উপর বর্তমান সরকারের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নির্ভর করছে। 

আমার কাছে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া- সেটা আগামীএক বছরের মধ্যে হোক বা দুই বছরের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, ভারতের সাথে আমাদের সব চুক্তি পুনর্বিবেচনাকরে, প্রয়োজনে সেগুলো বাতিল করা। অভ্যুত্থান এবং বিপ্লবের মধ্যে সাধারণ পার্থক্য বিদ্যমান। অভ্যুত্থানের লক্ষ্য থাকে কেবল শাসকের পরিবর্তন আর বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে সিস্টেমের পরিবর্তন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এখন আমাদেরকে বিপ্লবের দিকে ক্রমাগতধাবমান হতে হবে। তবে এই বিপ্লবের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন নেই, এবং অন্তর্বর্তীসরকারেরও কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শন বলে কিছু নেই। এটা সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিদ্বেষীরাজনৈতিক দর্শন। যারা বাংলাদেশে সেক্যুলার পরিচয়ে পরিচিত, তারা মূলত ইসলামোফোবিক। এইসেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনাহয়েছিল অষ্টাদশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁর মাধ্যমে, যা মূলত বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদেরউন্নতির জন্য সহায়ক ছিল। এই বাঙালি রেনেসাঁ আসলে ছিল বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁ, যেখানেমুসলমানরা ছিল সম্পূর্ণভাবে "অপর"। নিরোদ চৌধুরী “Autobiography of an Unknown Indian” বইটিতে বেঙ্গল রেনেসাঁ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। আওয়ামী লীগ এবং তথাকথিতসেক্যুলারদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ানও মূলত অষ্টাদশ শতকের বেঙ্গল রেনেসাঁ থেকে উদ্ভূত, যাছিল বাঙালি হিন্দুদের রেনেসাঁ, যেখানে মুসলমানদের কোনো স্থান ছিল না।

এই বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে আমাদেরকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং ভারতের আধিপত্যথেকে মুক্ত থাকার জন্য নতুন বাঙ্গালী মুসলিম বয়ান তৈরি করতে হবে। আমি যখন ভারতীয়আধিপত্যবাদ নিয়ে কথা বলতাম, তখন প্রথমদিকে আমাকে চরমপন্থী আখ্যা দেয়া হতো। যদিও তারাসরাসরি আমাকে সন্ত্রাসী বলতো না।  তাদের কাছে কেউ যখন চরমপন্থার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই সেসন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত হয়। তরুণরা এখন বুঝতে শুরু করেছে, ভারত আমাদের স্বাধীনতা ওসার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। ভারত আমাদের প্রধান শত্রু এটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বুঝতেপারছে। তবে এই বিপ্লবে আমাদের সফল হতে হলে আমাদেরকে নতুন বয়ান তৈরি করতে হবে।  

পশ্চিমারা ইসলামী দেশগুলোতে গণতন্ত্র চায় না। তারা সেখানে স্বৈরাচার চায়। ইসলামী দেশগুলোতেযদি উদার গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ইসলামিক শক্তিগুলোই শাসনক্ষমতায় বসবে। তাইআমেরিকাসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র প্রচার করলেও ইসলামি দেশে গণতন্ত্র চায় না। মিশরহলো এর একটি উদাহরণ। জাতিরাষ্ট্র এক ধরনের বাস্তবতা। যখন আমরা উম্মাহ নিয়ে কথাবলি, আমার প্রশ্ন হলো, গাযায় যা ঘটছে, সেখানে উম্মাহ কোথায়? গাযায় আমি কোনো উম্মাহ খুঁজেপাইনি। আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই ও বোনদের সাথে ওআইসি এবং আরব লীগ—এই দুই সংগঠনকেওগাযায় দাফন করা হয়েছে।

শাপলা:

সরকার শুধুমাত্র শাপলা গুম করার চেষ্টা করেনি বরং এই গণহত্যাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। শাপলা হচ্ছে রাসূল (সা) এর অবমাননার প্রতিবাদে মাদ্রাসা ছাত্রদের আন্দোলন। তথাকথিত সেক্যুলারমিডিয়ায় বহুদিন ধরেই রাসূল (সা)-কে অবমাননা করা হচ্ছিলো। ২০১৩ সালে লক্ষাধিক মাদ্রাসাশিক্ষার্থী এই অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকায় মার্চ করে। সরকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমূলক ক্ষমতাব্যবহার করে তাদেরকে দমন করে যেভাবে আগস্টের বিপ্লবকেও দমনের চেষ্টা করেছিলো। সেসময় সরকার“ইসলামি সন্ত্রাস” কার্ড ব্যবহার করে এই আন্দোলন দমন করে। যদিও “ইসলামী সন্ত্রাস” কার্ড বর্তমানেএতো প্রাসঙ্গিক না ঐ সময়ে যতটুকু প্রাসঙ্গিক ছিলো। পশ্চিমা বিশ্ব এবং ভারত তখন সরকারকে সমর্থনকরে এবং ইসলামিস্টদের বিপক্ষে সরকারের গণহত্যাকে সমর্থন জানায়। কারণ তারা মনে করেছিলোইসলামিস্টরা আন্দোলন করছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য। 

সরকার শুধু শাপলার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং এই গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাকরেছে। শাপলা হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর অবমাননার প্রতিবাদে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তথাকথিত সেক্যুলার মিডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাসূল (সা.)-কে অবমাননা করা হচ্ছিল। ২০১৩সালে, লক্ষাধিক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এই অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করে। সরকারতখন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমূলক ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের দমন করে, ঠিক যেভাবে আগস্টের বিপ্লবকেওদমন করার চেষ্টা করেছিল। সেই সময়ে, সরকার “ইসলামী সন্ত্রাস” কার্ড ব্যবহার করে এই আন্দোলনকেদমন করে। যদিও এখন এই “ইসলামী সন্ত্রাস” কার্ড এতোটা প্রাসঙ্গিক নয় তবে তখন তা খুবই কার্যকরছিল। পশ্চিমা বিশ্ব এবং ভারত তখন সরকারের পক্ষে দাঁড়ায় এবং ইসলামিস্টদের বিপক্ষে এই দমনমূলকপদক্ষেপকে সমর্থন জানায়, কারণ তারা মনে করেছিল ইসলামিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেআন্দোলন করছে।

এখানে শ্রেণির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী গ্রামীণ পরিবেশ ও নিম্নবিত্ত সমাজেরঅংশ। সেই সময় শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা দরিদ্র মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সমর্থন করেনি, যেমনটাতারা এবারের বিপ্লবে করেছে। আমার মনে হয়, এ কারণেই এবারের অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, আর ২০১৩সালের আন্দোলন সফল হয়নি। ২০১৩ সালে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা মনেকরেছিল, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দেশের “তালেবানাইজেশন” করতে চায়। তাই সরকার শাপলাকে সহজেইদমন করতে পেরেছিল। কিন্তু এবার সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান ও শহুরে মধ্যবিত্তরা নিজেরাই অংশগ্রহণকরায়, সরকার একই নীতি অনুসরণ করলেও তা ব্যর্থ হয়েছে।

ইসলাম প্রশ্ন:

বাংলাদেশে ইসলামের বিষয়ে আমাদের আলোচনা ১৯৭১ বা ১৯৪৭ থেকে শুরু করা উচিত নয়; বরং তাবাংলার স্বাধীন সুলতানদের সময় থেকে শুরু করতে হবে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তারা প্রথম বাংলাকেএকটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাদের আগে ভৌগোলিকভাবে বাংলার অস্তিত্বথাকলেও কোনো রাজনৈতিক সত্তা ছিল না—বাংলা ছিল বিভক্ত, ৮-৯টি অংশে বিভাজিত। শামসুদ্দিনইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম বাংলাকে একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে একীভূত করেন এবং ‘সুলতানঅব বাংলাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তাই বাংলার রাজনৈতিক পরিচয় মূলত মুসলিমদের হাত ধরেপ্রতিষ্ঠিত হয়। যদি আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি রেনেসাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই, তাহলে আমাদেরআলোচনা শুরু করতে হবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর স্বাধীন বাংলা সালতানাত থেকে।

১৯৭১:

বাংলাদেশে ইসলামকে অবৈধকরণের (Delegitimization) বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে, একাত্তর ইস্যুরসমাধান করতে হবে। এই প্রসঙ্গে তিনটি বিষয় আমাদের বুঝতে হবে। প্রথমত, পাকিস্তানি শাসক শ্রেণিরভূমিকা। তাদের ভূমিকা কেবল বাঙালিদের বিরুদ্ধে ছিল না; তারা বেলুচ, সিন্ধি, পাঞ্জাবিদের দরিদ্রঅংশ, পাঠান এবং পশতুনদেরও শোষণ করেছে। দ্বিতীয়ত, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। এটি ভারতের জনহিতৈষী কোনো পদক্ষেপ ছিল না। ভারত ১৯৪৭ থেকেই পাকিস্তানকে বিভক্ত করারচেষ্টা করে আসছে, কারণ পাকিস্তান ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি বড় বাধা ছিল। ভারত ১৯৪৭সালে এবং ১৯৬৫ সালে দুটি যুদ্ধ লড়েছে এবং দুটিই অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়েছে। ফলে ১৯৭১ছিলো ভারতের জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত সুযোগ। ইন্দিরা গান্ধী নিজেও একে "হাজার বছরের সুযোগ" হিসেবেউল্লেখ করেছিলেন। ভারত চেয়েছিল পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে, আর আমরা চেয়েছিলাম পাকিস্তানিশাসক শ্রেণির শোষণ থেকে মুক্তি। এটি ছিল উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক।

সেক্যুলার এবং আওয়ামী লীগের এই বয়ান যে “১৯৭১-এ ভারতের সহায়তার জন্য আমাদের চিরকৃতজ্ঞথাকা উচিত”—এটিকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। পাশাপাশি, জামায়াতে ইসলামেরও একাত্তর ইস্যুতে তাদেরঅবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তারা বলতে পারে, “আমরা রাজনৈতিক বুঝাপড়ার দিক থেকে সঠিকঅবস্থানে ছিলাম। আমাদের উদ্বেগ ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পর কিভাবে তা টিকিয়ে রাখব এবং কিভাবেভারতের আধিপত্য মোকাবেলা করব। তবে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করা আমাদের ভুল ছিল। আমাদের উচিত ছিল পাকিস্তান আর্মির ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।” এইভাবে, একাত্তরের ইস্যু থেকে এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ইসলামের অবৈধকরণ রোধ করা সম্ভব হবে।

শাহবাগ: 

শাহবাগ হচ্ছে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং শেখ হাসিনার সমর্থনে ইসলামকে অবৈধকরণের প্রচেষ্টা। শাহবাগের মূল লক্ষ্য কেবল জামায়াতের নেতারা ছিলেন না বরং এর লক্ষ্য ছিলো বাঙ্গালীজাতীয়তাবাদের বয়ানের ভিত্তিতে সেক্যুলারিজমের চূড়ান্ত বিজয়। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিলোশাপলা আন্দোলন। তারা বললো, আমাদের ইসলাম ধর্ম এবং আমাদের নবী (সা.)-কে অপমান সহ্যকরা হবে না। ১১ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি শাহবাগ পরাজিত হয়েছে আর শাপলা জয়ী হয়েছে। শাহবাগ হয়তো জামাতের কয়েকজন নেতার ফাঁসি নিশ্চিত করতে পেরেছে কিন্তু তাদের যে মূল লক্ষ্য- বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামকে সম্পূর্ণরুপে অপ্রাসঙ্গিক করা এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিজয়- সেক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছে। ৭১-এররাজাকারের বর্ণনাও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এটাই শাপলার বিজয়। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ থেকে পালিয়েভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রমাণ করে, রাজনৈতিক এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছেন। 

তানজীন দোহা

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ইসলাম প্রশ্ন: 

প্রথমত আমি শুরু করতে চাই, বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম বড় সংকট হলো ইতিহাস, রাজনৈতিকঠিকুজি (political geneaology) ও রাষ্ট্র নির্মাণে ইসলাম প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে যাওয়া। আমাদের পতিতশাসক শুধুমাত্র স্বৈরতান্ত্রিক শাসক না বরং আমি ক্যামেরুনিয়ান তাত্ত্বিক আশিলি এম্বেবের বরাতেবলবো—সেক্যুলার লাশতান্ত্রিক (Nacropolitical) সরকার যা উত্তর উপনিবেশী সময়ে লাশ বন্দোবস্তকরার প্রশ্নকে মোকাবেলা করে। ২০১৩ সালের শাপলা গণহত্যায় নিহতদের নিয়ে আমার কাজ। একাজের জন্য- এমনকি একজন গবেষক হয়েও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বা রাষ্ট্রের দমনযন্ত্র থেকেনিজেকে দূরে রাখা আমার জন্য কঠিন ছিলো। হাসিনা সরকারের কর্মকান্ডের মূলে ছিলো ওয়ার অনটেরর। তারা সাংবিধানিক ভিত্তির উপর লাশতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছে। তারা বিভিন্নভাবে সংবিধানসংশোধন করেছে এবং পুরনো সংবিধানে ফিরে না যাওয়ার নীতিও তৈরি করেছে। এই সরকারকেসংবিধান ভিত্তিক লাশের রাজনীতি বা সংবিধান ভিত্তিক ফ্যাসিজম বলা যায়। এই কাঠামো ৭২ এরসংবিধানে ফিরে যায় যা রাজনীতিতে ইসলাম প্রশ্নকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। যখন ছাত্ররাস্লোগান হিসেবে “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার” ব্যবহার করে, তখন তারা পতিত প্রধানমন্ত্রীরবিরুদ্ধে এই অবমাননাকর শব্দের প্রতিবাদ করে—যা তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যব্যবহৃত হয়। জঙ্গি, সন্ত্রাসী, রাজাকার শব্দের রেটোরিক্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ“উম্মাহ” ধারণার বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। 

রাজনৈতিক ও সামাজিক এই বিদ্রোহকে সত্যিকারার্থে বিপ্লবে পরিণত করতে হলে ইসলাম প্রশ্নঅমীমাংসার রাজনৈতিক ঠিকুজি নিয়ে সঠিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এখন অনেকেই বাংলাদেশে“পোস্ট ইডিওলজি”, “পোস্ট ইসলামিজম” শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। এটা ইসলাম প্রশ্ন মীমাংসা থেকেদূরে থাকার একটা কৌশল। এটা মূল প্রশ্নকে উপেক্ষা করার কৌশল যে প্রশ্ন এই সম্পূর্ণ আন্দোলনকেউস্কে দিয়েছে। 

অবশ্যই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন ধারার অংশগ্রহণ ছিলো এতে কোনো সন্দেহ নাই। ইসলামীভাবধারার অনেকেও এতে শামিল ছিলেন। মাদ্রাসা ছাত্ররাও এতে গভীরভাবে যুক্ত ছিলো। ২০১৩ সালেযখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উপর গণহত্যা চালানো হয় তখন সরকার প্রথমে তা অস্বীকার করে এবং পরেগোপন করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি এবং মূলধারার রাজনীতিবিদরা গুরুত্বসহকারেএটি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়, কেননা বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি ওয়ার অন টেররের যুক্তি ও মনস্তত্ত্বদ্বারা প্রশিক্ষিত। ইসলাম ও ইসলামী কর্তাস্বত্বার অপনোদন হাসিনার তৈরিকৃত এই ধরনের হত্যাযন্ত্রেরএকটি মৌলিক বিষয়।

বাংলাদেশের মধ্যে এখন যেভাবে পোস্ট ইসলামিজম শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে তা রাষ্ট্রপ্রশ্নে আবার ইসলামপ্রশ্নকে উপেক্ষা করতে চাচ্ছে। যদি আমরা সত্ত্বাতাত্ত্বিক (Ontological) সেক্যুলারিজমের কথা বলি, এরঅর্থ হলো আমি সত্ত্বাতাত্ত্বিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে এমন কাউকে শত্রু বিবেচনা করব, যারাপাকিস্তানের প্রতি কোনো ইতিবাচক ধারণা রাখে বা ইতিহাসের এমন কোনো ব্যাখ্যা পোষণ করে, যাএকাত্তরের প্রচলিত বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং যা বিভিন্ন প্রপাগান্ডা মেকানিজম ও সাংস্কৃতিকউৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। একইভাবে, যদি কেউ কোনো ইসলামী দলঘেষা হয়, তবে তাকেও শত্রুহিসেবে দেখা হবে। এটাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী বয়ানে “রাজাকার” শব্দের উপযোগিতা।  

সবাই জানে ছাত্ররা এই শব্দকে কৌতুক হিসেবে নিয়েছে এবং তারা এই ধরণের বয়ান এবং রাষ্ট্রের শত্রুচিহ্নিতকরণকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা দেখেছি পাকিস্তানি ছাত্ররাওএকই ধরণের শব্দ ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য যাসত্যিকার অর্থেই অভূতপূর্ব এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। 

চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এক ধরণের সেক্যুলারিটি সত্ত্বাতাত্ত্বিক ভিত্তি (Ontological basis) থেকেনিয়ন্ত্রণমূলক ভিত্তির (disciplinary basis) দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে যা সেক্যুলার রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই মুসলমানদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে যেখানে ইসলাম প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যাবে। 

যখন পোস্ট ইসলামের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন রেটোরিক ব্যবহার করা হয় তখন তা রাষ্ট্রের ভবিষ্যতেরপ্রশ্নে ইসলামকে মূল প্রশ্ন হিসেবে চিহ্নিত করতে চায় না। এখানে ধারণাটা হলো, ইসলামিস্টদেরকেইসলামের প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী বিভিন্ন বৈচিত্র্যে বিভক্ত করা। এর উদ্দেশ্য হলো ইসলামকে ক্রমশঅপ্রাসঙ্গিক করে তোলা (ডিএসেন্সিয়ালাইজেশন অফ ইসলাম)। এটি মূলত কুরআন এবং হাদীসেরকেন্দ্রীয়তা এবং ইসলামের সংজ্ঞা নির্ধারণকারী কাঠামোকে অপসারণ করে। এর পরিবর্তে, ইসলামেরঅন্য কোনো রূপে ফোকাস করা এবং ইসলামের বিভিন্ন রুপ আছে ইত্যাদি বলা হয় যার ধারণা আমরাসাহাব আহমেদ থেকে পাই। এই ধরণের চিন্তাভাবনা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা কর্তাসত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণের নিয়ন্ত্রণমুলক পদ্ধতি। 

আশার দিক হচ্ছে, অনেকেই আয়নাঘর থেকেই মুক্ত হয়েছেন। ইসলামিক বিভিন্ন গোষ্ঠীও পরিবর্তনেরব্যাপারে আশাবাদী। তারা খুশী কারণ হাসিনা আর ক্ষমতায় নেই। যেমন আমিও খুশী, কারণ এখনচাইলে দেশে গিয়ে কোনো গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারী ছাড়াই গবেষণা করতে পারবো। বিশেষ করেজামাতে ইসলাম যেভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন মোকাবেলা করেছে তা আশাব্যঞ্জক এবং ক্ষমতা পরিবর্তনে তারাসহায়তা করেছে। এটা ভালো লক্ষণ। তবে বিএনপি ২০০১ সালে জামাতের সাথে একত্রে কাজ করেছেবাইরের হস্তক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত। তখন তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভূতপূর্বভাবে নির্বাচনে বিজয়ীহয়েছিলো। কিন্তু এখন দুই দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি জামাতেরব্যাপারে সমালোচনামূলক মন্তব্য করছে যা আশঙ্কাজনক। কেননা হাসিনা চলে যেতে পারে কিন্তু ভারতএখনো বাংলাদেশে তার স্বার্থ নিয়ে আগ্রহী। এই বিপ্লব ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা এবংআধিপত্যবাদী ভারতীয় আগ্রাসনের গালে চপেটাঘাত। তারমানে এই নয় যে, তারা তাদের স্বার্থ ত্যাগকরবে। তারা ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাবেনা। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো অনেক র এজেন্ট রয়েছেযারা সমস্ত জায়গায় অনুপ্রবেশ করেছে। এজন্য তারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিকদলের রেটোরিককে প্রভাবিত করতে পারছে। এমনকি এখনো বিএনপি একাত্তরের বয়ান ব্যবহার করেজামাতের সমালোচনা করছে, যে বয়ান অতীতে হাসিনা স্বয়ং ব্যবহার করতেন। তাদের মধ্যে মতপার্থক্যথাকতে পারে। কিন্তু তারা কেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও ভালগার সেক্যুলারিজমের রেটোরিক ব্যবহারকরছে ইসলামী ধারাগুলো বিপরীতে। এসবই এমন কিছু বিষয় যা আমি সামনে আনতে চেয়েছি। রাষ্ট্রেরজন্য ইসলামের প্রশ্ন মীমাংসা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশ ইসলামের চেতনা বহন করে। রাষ্ট্রকে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। যদি রাষ্ট্র ও সংবিধান ইসলামের প্রতিফলন না ঘটায় এবং নতুনশাসন ব্যবস্থা কেবল রেটোরিক্যাল ভাষা ব্যবহার করে এই প্রতিফলন এড়িয়ে যায়, তাহলে আমাদের মধ্যেনতুন উদ্বেগ তৈরি হবে।

এখন মূলত পর্যবেক্ষণের সময়। নতুন রাষ্ট্র সংস্কার কিভাবে হবে তা এখনো অজানা। এমন অনেক প্রশ্নরয়েছে, যেগুলোর মোকাবিলায় রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া কতটুকু প্রভাবিত হবে, সেটাও অনিশ্চিত। আমরাইতিবাচকভাবেই ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের নিত্সের দৃষ্টিভঙ্গিতেসন্দেহপ্রবণ হতে হবে (hermeneutics of suspicion) - বিশেষ করে কিভাবে নতুন বয়ান তৈরি হচ্ছে।

বিপ্লব হচ্ছে, সিস্টেমের পরিবর্তনের পাশাপাশি জনগণের রাজনৈতিক এবং নৈতিক চেতনার প্রতিফলনরাষ্ট্রে ঘটতে হয়। যদি এই প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে রাষ্ট্র জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করেনা। রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব বিদ্যমান। এর মধ্যে একটা ধারণা হচ্ছে মানুষ যখন পরিবারের মধ্যে থাকেতখন তাদের চেতনা অনুভূতি ও মনোভাবের পর্যায়ে থাকে। মানুষ যখন সমাজে থাকে তখন তাদেরচেতনা আন্তঃব্যক্তিয় স্বতন্ত্র পর্যায়ে (Interpersonal Individula level) থাকে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৌঁছালেবৃহত্তর সম্প্রদায়ের চেতনার বহিঃপ্রকাশের সম্ভাবনা থাকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, হাসিনা মানুষের চেতনাকেনিয়ন্ত্রণ করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ব্রাহ্মণ ঐতিহ্যের গভীর সংযোগরয়েছে, এর বিপরীতে ইসলামী চেতনা বিকশিত হয়েছে, যা উপেক্ষা করা অসম্ভব।

বর্তমানে যে সংবিধান বিদ্যমান এটিকে বাতিল করা প্রয়োজন। জাতীয় সমঝোতা তৈরি করা প্রয়োজন যা১৯৭৫ সালে ইতোমধ্যে হয়েছে। জাতীয় সমঝোতা বলতে কী বোঝায় আমাদেরকে তা অনুধাবন করতেহবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ভারতীয়দের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। অন্যযেসব দল সংগ্রামে নিযুক্ত, তাদের জন্য নতুন রাজনীতি গড়ে তুলতে একটি সুষ্ঠু সমঝোতা প্রক্রিয়াআবশ্যক। সেক্যুলারিজমের প্রশ্ন আমার নিজস্ব কোনো চিন্তা না। তবে ইসলাম সংক্রান্ত প্রশ্নের সাথেবাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার ধারণা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংঘর্ষ এবং শত্রুতাবাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান। এই জাতি পাকিস্তান ধারণা থেকে বের হয়ে প্রথম থেকেইপাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধী হিসেবে তৈরি হয়েছে। এই ব্যাপারে আমাদেরকে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। ২০২৪ সালে সিভিল সোসাইটি ক্রমাগত বলে যাচ্ছে এটি আরেকটি একাত্তর। 

শাপলা:

চব্বিশে শাপলার স্পিরিট বিদ্যমান। শাপলায় যেভাবে লক্ষাধিক মাদ্রাসা ছাত্র-উলামারা রাসুলেরভালোবাসায় বের হয়ে এসেছে তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রে উপেক্ষিত হতে পারে না। শাপলা গণহত্যা বা প্রথমদিককার সংগ্রাম যা ইসলামের স্পিরিট বহন করে তা ব্যতীত বাংলাদেশ তাঁর সংকট কাটিয়ে উঠতেপারবেবনা। বিষয়টি সবসময় আমাদের জন্য একটা সমস্যা হিসেবেই রয়ে যাবে। তাই ইতিহাসের ব্যাপারেনতুন করে ভাবতে আমাদের নিজেদেরকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। ইসলাম প্রশ্ন এবং জাতীয় সমঝোতারমাধ্যমে কিভাবে একটি ইসলামবান্ধব রাষ্ট্র গঠিত হবে যা ইসলামের স্পিরিট বহন করবে তা আমাদেরচিন্তা করতে হবে। 

ভারতীয় আধিপত্যবাদ: 

নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা ব্যবস্থার দিক থেকে রাষ্ট্রকে ভারতবিরোধী করতে পারাটাই বাংলাদেশের লড়াই। এই লড়াই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। এই সময়ে আমাদেরকে অন্যান্য প্রতিবেশি দেশগুলোরব্যাপারেও ভাবতে হবে যারা এই প্রক্রিয়ায় আমাদের সহায়তা করতে পারে। এ জায়গা থেকে পাকিস্তানআমাদের স্বাভাবিক মিত্রতে পরিণত হবে। তাই আমাদেরকে তাই আমাদের শুধুমাত্র ইতিহাসেরনেতিবাচক দিকগুলো যেমন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের কথা ভাবলেই চলবে না; বরং ১৯৪৭ সালেএই দেশের বাঙালি ও কৃষকরা যে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সমর্থন করেছিল, সেটিওবিবেচনায় নিতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরবে, এবং আমাদেরকেসেই ইতিহাসের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় মীমাংসার পথে হাটতে হবে। এজন্য আমাদের ইতিহাস পুনর্মূল্যায়নকরা প্রয়োজন।

শেষ মন্তব্য:

আমি মনে করি, প্রশ্নটা হলো, কীভাবে আমরা নিশ্চিত করবো যে এটি একটি বিপ্লব? কীভাবে আমরানিশ্চিত করবো যে ভারতীয় গোয়েন্দা, ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা আমাদেরজীবনকে ব্যাহত করবে না এবং আমাদের সার্বভৌমত্ব ফিরে আসবে। এজন্য বাংলাদেশের বিভিন্নগোষ্ঠীকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে এবং এর জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আমাদেরসবারই এতে বিভিন্ন ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর, যখন হ্যাকাররাবাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিল, তারা লিখেছিল, "এটা এখন যুদ্ধ।" আমিবলতে চাই, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, এবং বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের আগ্রহ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

সূত্র: Bangladesh’s Revolution: Challenges, Opportunities and the Umma