বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন এক শতাব্দীর জীবন্ত ইতিহাস। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন আদর্শবাদী মানুষ হিসেবে মাওলানা অমর হয়ে রয়েছেন । মরহুম জনাব আবুল মনসুর আহমেদের ভাষায়, “মাওলানা আকরম খাঁ একটিমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না। অন্যান্য অনেক নেতার মত তিনি শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতিনিধি-যুগের প্রতীক। স্বয়ং একটা যুগ বাহির হইতে তাঁর ব্যক্তিত্বের বিরাটত্ব, তাঁর সাফল্যের বিপুলতা, তার প্রাতিষ্ঠানিক যুগের জীবনের বিস্তৃতি দেখিলে বলিতেই হইবে, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। মাওলানা সাহেবের বিরাট ব্যক্তিত্বরূপী সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিন্তানায়ক ও সমাজ সংস্কারের শ্রেষ্ঠ মহৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটিইয়াছিল অপূর্ব সামঞ্জস্যে। তিনি একাধারে ছিলেন সবই। সকল অমৃত ফলের তিনি ছিলেন কল্পতরু।’’ বস্তুত মাওলানা সাহেবের বিস্তীর্ণ কর্মমুখর জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করলে উক্ত বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়।
মাওলানা আকরম খাঁ যখন কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন তখন এ দেশের মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিলেন অনগ্রসর। একদিকে বৃটিশ শাসন ও শোষণ এবং অন্যদিকে প্রতিবেশী সমাজের অভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাবের ফলে বাংলার মুসলমানরা অসহায়ের মত দিন কাটাচ্ছিল। তাঁদের আশার বাণী শোনাবার, তাঁদের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য কেউ তখন ছিলনা। সামাগ্রিকভাবে যারা মুসলমান সমাজের দুর্গতির কথা চিন্তা করতেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন কলকাতার বাসিন্দা। ফলে কলকাতার বাইরে বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের প্রায় কোনো যোগাযোগই ছিল না। উপরন্তু বিভিন্ন ধর্মের প্রভাবে মুসলমান সমাজে অনুসৃত বিজাতীয় সংস্কৃতি, খ্রিষ্টান পাদ্রীদের অপপ্রচার এবং সাধারণ ‘মোল্লা’ শ্রেণীর ইসলামের নীতি সম্পর্কে অপব্যাখ্যা মুসলমান সমাজের সামগ্রিক অবস্থাকে অসহনীয় করে তুলেছিল। ছাত্র অবস্থাতেই মাওলানা আকরম খাঁ মুসলমানদের এ অধঃপতন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সমাজ-কল্যাণমুলক কাজ ও বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক ভ্রমণ করেন।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেন যে, বাংলার মুসলমানদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন তাদেরকে সংগঠিত করার, ইসলাম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা দূর করে সত্যিকার ইসলামের নীতি সর্বসমক্ষে তুলে ধরার এবং সর্বোপরি মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করার। এ কাজে সফলতা লাভের উপায় হিসেবে তথা বলিষ্ঠ জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি পত্রিকা প্রকাশের প্রতি আগ্রহী হন। এজন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন। মোহাম্মদী, সেবক, জামানা, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকা তার সাধনারই উপজাত ফল। মুসলমান সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টির মূলে মাসিক ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী এবং দৈনিক সেবক ও আজাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এসব পত্রিকার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে তিনি মুসলমান সমাজের সার্বিক উন্নতির পথকে তিনি উন্মুক্ত করে দেন। পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি গড়ে তোলেন একটি সুসংগঠিত জনমত।
কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ ও জনপ্রিয় করে তোলা একেবারে সহজ কাজ নয়। আধুনিক কালেও পত্রিকা প্রকাশ রীতিমত একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ঊনবিশ শতাব্দীর শুরুতে পত্রিকা প্রকাশ করা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল তা হয়ত এখন অনুমান করাও সম্ভব নয়। অথচ এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মাওলানা সাহেব মাত্র এক টাকা তেরো পয়সা নিয়ে হাত দেন। নিজস্ব তেরো পয়সা এবং চড়ুইভাতির চাঁদা হিসেবে খালা আম্মার দেয়া এক টাকা সম্বল করে তিনি কলকাতায় যান পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। সৌভাগ্যক্রমে তিনি একজন ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎ পান। উক্ত ব্যবসায়ী তাকে একটা বাংলা ফরায়েজ তৈরী করে দিতে বলেন। তিনি এজন্য তাকে পঞ্চাশ (মতান্তরে ষাট) টাকা দেন। অর্থাৎ মোট একান্ন টাকা তেরো পয়সার মূলধন নিয়েই মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। এ সম্পর্কে মাওলানা সাহেব নিজে লিখেছেন, ‘আমি যখন কাগজ বাহির করার বাতিকে কলকাতার রাস্তায় উদভ্রান্তের মত ঘুরিয়া বেড়াই সে সময় তিনি (কাজী আবদুল খালেক) আমাকে মোহাম্মদী নামক কাগজ বাহির করতে অনুরোধ করেন এবং তাহার মোহাম্মদী আখবর-এর ফাইলটাও স্নেহের স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ আমাকে প্রদান করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৮৭৭ সালের ৪ঠা জুন কাজী আবদুল খালেক কলকাতা থেকে আখবর-এ-মোহাম্মদী নামে একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৭৮ সালের ২৯শে মার্চ থেকে সাপ্তাহিক হিসাবে পত্রিকাখানা প্রকাশ পেতে থাকে। পত্রিকাটির ৯৬ সংখ্যা প্রকাশ পাওয়ার পর আর্থিক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এ পত্রিকায় মাওলানা সাহেব সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর আগে তিনি আহলে হাদীস [সাপ্তাহিক] পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। জনাব আবদুল ওহাব সিদ্দিকী তাঁর ‘মহান স্মৃতি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, মাওলানা আকরম খাঁ আখবর-এ-মোহাম্মদী পত্রিকার দায়িত্বগ্রহণ করার পর তিনি শুধুমাত্র ‘মোহাম্মদী’ নামে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
মাসিক মোহাম্মদীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮ আগষ্ট ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় পত্রিকার মালিক ছিলেন মোহাম্মদ আক্কাস আলী এবং সম্পাদক হিসেবে নাম প্রকাশিত হয় মাওলানা আকরম খাঁর। দ্বিতীয় সংখ্যায় পত্রিকার মালিকানার পরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে পত্রিকার মালিক হন হাজী আবদুল্লাহ নামে জনৈক তেল ব্যবসায়ী। হাজী আবদুল্লাহর বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায় এবং তিনি ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁর পিতা মাওলানা আবদুল বারী খাঁ’র বন্ধু। মাসিক পনের টাকার বেতনে মাওলানা সাহেব পত্রিকায় যোগ দেন। মাসিক মোহাম্মদী প্রথমে পাক্ষিক এবং সম্ভবত ১৯০৭ সালে সাপ্তাহিক আকারে প্রকাশ পায়। মাসিক মোহাম্মদীর ৫ম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯২৭ সালের ৬ নভেম্বর পুনরায় মাসিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। যা হোক, কাজী আবদুল্লাহ পত্রিকা ব্যবসায়ে কয়েক হাজার টাকা লোকসান দেওয়ার পর পুনরায় পত্রিকা প্রকাশে তাঁর অপরাগতা প্রকাশ করেন। তিনি মাওলানা সাহেবের কাছে প্রেস এবং পত্রিকা বিক্রি করে দেন। অনেকের মতে তিনি মাওলানা সাহেবকে পত্রিকার মালিকানা স্বত্ব দিয়ে দেন। প্রেসটিও তাঁকে দিয়ে দেন। যা হোক, পত্রিকা পরিচালনা করার মত অর্থ মাওলানার ছিল না। তবু তিনি হতাশ হন নি। চীনা বাজার [কলকাতা] থেকে কাগজ কিনে তা মাথায় করে তিনি অফিসে নিয়ে আসতেন। এ সময় তিনি জনৈক মাওলানা মোহাম্মদ আব্বাস আলীর [মতান্তরে আক্কাস আলী] বিশেষ সাহায্য লাভ করেন। সাপ্তাহিক মোহাম্মদী প্রকাশিত হয় মুসলমানদের মুখপাত্র হিসেবে। তৎকালীন সরকারও মোহাম্মদীর বক্তব্যকে মুসলমান সমাজের বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করতেন।
মাসিক মোহাম্মদী ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী মুসলিম জাগরণে যে অনন্য ভূমিকা পালন করে তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মাসিক মোহম্মদী ছিল ব্রাক্ষ্মধর্মের মুখপাত্র উচ্চাঙ্গের সাময়িকী ‘প্রবাসী’র প্রতিদ্বন্দী। তদুপরি, একদল নবীন মুসলমান সাংবাদিক ও লেখকের হাতেখড়ি হয় এ পত্রিকাতেই। মাসিক মোহাম্মদীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হলো, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে শ্রী-পদ্ম প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্বে সোচ্চার প্রতিবাদ। মাসিক প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্রোপাধ্যায় ‘শ্রী-পদ্ম’ মনোগ্রামের সমর্থনে সম্পাদকীয় প্রকাশ করলে মাওলানা আকরম খাঁ মাসিক মোহাম্মদীতে এক যুগান্তকারী সম্পাদকীয় লেখেন। মাওলানা লিখেনঃ ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রী-পদ্ম যে সম্পূর্ণ নির্দোষ ব্যাপার এবং নিছক সাম্প্রদায়িকতাগ্রস্ত হইয়া যে বাংলায় মুসলমান সমাজ তাহার বিরুদ্ধে আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছেন, প্রবাসির প্রধান সম্পাদক মহাশয় ইহা সপ্রমান করার জন্য গত কয়েক মাস হইতে বিশেষ শ্রম স্বীকার করিয়া আসিতেছেন। শ্রী’র মানে যে হিন্দু দেবী বিশেষও বটে এবং সেই দেবী যে ‘পৌরাণিক মতে কমলাসনা’ সম্পাদক নিজেও তাহা স্বীকার করিতেছেন। কিন্তু যেহেতু ‘শ্রীর অর্থ সম্পদ, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য ইত্যাদিও হইতে পারে। অতএব মুসলমানের আপত্তিটা অযৌক্তিক, সম্পাদক মহাশয়ের প্রথম যুক্তির সার কথা ইহাই। এই সঙ্গে তিনি আরো বলিয়াছেন যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও পদ্মের চিত্রের মধ্যস্থিত শ্রী শব্দটির পূজা করেন না, ধ্যান করেন না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কমলাসনা হিন্দু দেবীর পূজা অনুষ্ঠান কেউ সরকারী ভাবে করেন নাই। কিন্তু বাংলার সমগ্র হিন্দু সমাজ এ কমলাসনা ‘শ্রী’ দেবীকে বাণী বিদ্যাদায়িনী বলিয়া প্রতি বছর পূজা করিয়া আসিতেছেন। ইহার জন্যে অফিস আদালতে ও স্কুল-কলেজে ছুটি দেওয়া হইয়া থাকে এবং হিন্দু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রায় সকলেই ভক্তি ও শ্রদ্ধার সহিত এই পূজায় যোগ দিয়া থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ ও হোস্টেলগুলিতে এই পূজার আগ্রহ আজ সর্বব্যাপীরূপে দেখা দিয়েছে।...
‘পদ্মফুল মুসলমানরাও ব্যবহার করিয়া থাকেন। অনেক মুসলমান মসজিদের গায়ে পদ্মখোদিত আছে।’ ঠিক কথা, মুসলমান পাড়ায় দীর্ঘ-পুষ্কুরিণীতে শত শত পদ্মফুল ফুটিয়ে থাকে, স্থানে স্থানে পদ্মের পাতায় মুসলমানরা ভাত পর্যন্ত খায়, দরকার মত ঔষুধার্থে পদ্মমধু ব্যবহারও করিয়া থাকে। রামানন্দ বাবু ইহাও নিশ্চয় লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে, মসজিদের পদ্মপত্রগুলি খোদিত হইয়া আছে বড় বড় প্রস্তর খন্ডের উপর। মুসলমানরা আবার মাটি দিয়াও মসজিদ নির্মাণ করে। বাঁশ ও খড় দিয়া তাহার উপরিভাগও ছাইয়া থাকে। কিন্তু তাই বলিয়া এরূপ যুক্তিবাদের অবতারণা করা কি সঙ্গত হইবে যে, পাথরের বা বাঁশ-খড়ের নির্মিত কালী দূর্গার মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রতিবাদ করার অধিকার হইতে মুসলমান সমাজ ন্যায়তঃ বঞ্চিত হইয়া পড়িয়াছে। জড় পদার্থের ব্যবহার আর জড়পূজা কি একই কথা?’’
মাসিক মোহাম্মদীতে এ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রবাসী সম্পাদক সম্ভবত আর কোনো মন্তব্য করেন নাই। এ আন্দোলনে মুসলমান ছাত্রসমাজ মারমুখী হয়ে ওঠে এবং ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা মরহুম জনাব আবদুল ওয়াসেক। এ তীব্র আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘শ্রী’ বাদ দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, এ আন্দোলনের পর থেকে মুসলমানেরা তাদের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ ব্যবহার বন্ধ করে দেন। শুধু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তিকর মনোগ্রামের বিরুদ্ধে মাসিক মোহাম্মদী প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেনি, মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপপ্রচার ও আপত্তিকর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মাসিক মোহাম্মদীর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ বিশেষ সংখ্যাটির নাম দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা। শতাধিক পৃষ্ঠাসম্বলিত এ সংখ্যায় বহু সারগর্ভ রচনা প্রকাশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুসলমান ছাত্রদের উপর উর্দু ভাষা চাপাবার চেষ্টা করে। মাসিক মোহাম্মদী এ প্রচেষ্টাকে ‘গোদের ওপর খাড়ার ঘা’ বলে আখ্যায়িত করে। প্রবাসী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেই মাওলানা আকরম খাঁ চুপ করে ছিলেন না। অধ্যাপক মুহাম্মদ মুনসুর উদ্দিনের ভাষায় [আকরম খাঁর সাহিত্য সাধনা শীর্ষক প্রবন্ধ] ‘‘মোহাম্মদীর মহাগৌরব এই যে একদল নবীন মুসলমান সাহিত্যিকদের এইখানে প্রথমে হাতে খড়ি এবং ‘শিখা’ দলের উৎকট র্যাসনালিজমবাদী আবদুল ওদুদের মুসলিম সাহিত্য সমাজকে’ একেবারে ম্লান করিয়া দেয়। ইহাও আকরম খাঁর একটি সুকীর্তি বলা যেতে পারে।”
সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকা প্রকাশের দিন তারিখ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কারো মতে ১৯০৭, কারো মতে ১৯০৯, কেউ বলেন ১৯১০, কেউ বলেন ১৯১১ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী প্রকাশিত হয়। প্রথমে মাওলানা আকরম খাঁ এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পরে জনাব নাজির আহমদ চৌধুরী ও তারপর মাওলানা সাহেবের পুত্র মোহাম্মদ খায়রুল আনাম খাঁ’র নাম সম্পাদক হিসেবে হিসেবে ছাপা হয়। সাপ্তাহিক মোহাম্মদী প্রকাশিত হওয়ার অতি অল্পদিনের মধ্যেই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল মুসলমান লেখক ও সাংবাদিক তৎকালে বাংলায় একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। মুসলমানদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেয়াই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বস্তুত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ছিল তৎকালীন মুসলমান সমাজের ধ্যান-ধারণা ও সুখ-দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। মুসলমানদের জাতীয় মুখপাত্র হিসেবেও পত্রিকাটি অল্পদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর গ্রাহক সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। গ্রাহকগন প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে, তারা টাকা দিয়াও সময়মত পত্রিকা পান না। এ ব্যাপারে মাওলানা সাহেব তদন্ত করে দেখতে পান যে হিন্দু পিয়নরা মুসলমানদের বাড়িতে পত্রিকা বিলি করতে অনাগ্রহী থাকায় গ্রাহকদের পত্রিকা পেতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। হিন্দু পিয়নদের অভিযোগ ছিলঃ ‘‘মুসলমানরা যা তা খায়। তাদের বাড়িতে মোরগের পাখা পালক থেকে আরম্ভ করে গরুর হাড় পর্যন্ত পড়ে থাকে। হিন্দুকে ওখানে গেলে জাতভ্রষ্ট হতে হয়।” যাহোক, পোস্টাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এর স্থায়ী সমাধান হয়। তৎকালীন পোস্টাল কর্তৃপক্ষ ছিলেন একজন ইউরোপীয়ান।
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় পত্রিকাটির প্রচার অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। তুরস্ক সম্পর্কে বৃটিশ নীতির কড়া সমালোচনা তৎকালীন সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। এজন্য মাওলানা সাহেবকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডেকে পাঠান হয়। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের জনৈক নবাব উপাধিধারী বাঙ্গালী মুসলমান সদস্য মাওলানা বৃটিশ নীতির পক্ষে লেখনী ধারণ করার অনুরোধ জানান। তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে দৈনিক পত্রে রুপান্তরিত করার জন্য সরকারী অর্থ সাহায্যেরও আশ্বাস দেন। এ প্রস্তাবের উত্তরে মাওলানা সাহেব বলেন, ‘দেখুন জনাব, খলিফা সুলতানের বিরুদ্ধে চিন্তা করার আগেই যেন আমার মস্তিষ্ক বিকল হইয়া যায়। তাঁহার বিপক্ষে লেখনী ধারণ করার পূর্বেই যেন আমার হাত অবশ হয়ে পড়ে। তাঁহার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টার আগেই যেন আমার নশ্বর দেহের অবসান ঘটে, খোদার দরবারে এই-ই প্রার্থনা।’ উক্ত সদস্য এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মাওলানা সাহেবকে ভয় দেখান যে, ইচ্ছা করলেই তিনি তাঁকে গুলি করার আদেশ দিতে পারেন। এতেও বিচলিত না হয়ে মাওলানা সাহেব বলেন, “আমি জীবনে বহুবার শিকার করিয়াছি। বন্দুকের গুলিতে বহু পাখি মারিয়াছি। আমার প্রতি গুলি নিক্ষিপ্ত হলে মারা যাইতে পারি, এ ভালভাবেই জানি। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন, আমাকে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করা হইলে আমার দেহ হইতে যত বিন্দু রক্তপাত হইবে বাংলার বুকে ঠিক ততজন আকরম খাঁ পুনরায় জন্মিবে।’’
১৯২৬ সালে কলকাতায় সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সময় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী মুসলমানদের প্রাণের আশার সঞ্চার করে। এ সময় মুসলমানদের সংগঠিত করে তিনি যে কোনো সম্ভাব্য দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানান। এ সময় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী অনন্য ভূমিকা পালন করে। সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর প্রিন্টার হিসেবে মাওলানা সাহেবকে এক বছর জেল খাটতে হয় এবং পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। কলিকাতা চীফ প্রেসিডেন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ সুইনহোর এ মামলার বিচার করেন। বিচারকালে মাওলানা সাহেব অত্যন্ত সাহসের সাথে বলেনঃ ‘তোমরা আমাদের আন্দোলনকে গলা চেপে মারবার জন্য আমাদিগকে ধরছ। দন্ড যে দেবেই তাতে সন্দেহ নেই। এজন্য তোমরা এত ব্যস্ত যে, অপরের একটা প্রেরিত পত্র উপলক্ষ করে আমাকে ধরতে হলো। একটু সময় পেলে বা স্থির হয়ে চিন্তা করতে পারলে তোমাদের কাজের মত অনেক জিনিস পেতে। বাংলাদেশে আমি শত শত বক্তৃতা দিয়েছি, তিনখানা কাগজে নিয়মিতভাবে আমার লেখা বের হচ্ছে-কিন্তু ধরলে একখানা পরের পত্রে এবং প্রিন্টার স্বরূপে। কাজেই যখন তোমাদের এই মনের অবস্থা তখন নিতান্ত বাতুল না হলে তোমাদের কাছে কেহ স্টেটমেন্ট করতে যাবে না- এই আমার স্টেটমেন্ট।”
মাসিক ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর মাধ্যমে মাওলানা আকরম খাঁ মুসলমান সমাজে যে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তা সবিস্তারে বর্ণনা করতে হলে প্রবন্ধের ক্ষুদ্র কলেবরে সম্ভব নয়। এছাড়া আল-ইসলাম দৈনিক সেবক, দৈনিক আজাদ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন, তা আজাদী আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরিশেষে ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে মাওলানা সাহেবের অষ্টম মৃত্যু বার্ষিকীতে দৈনিক ইত্তেফাক ‘অবিস্মরণীয় পূর্বসূরী শীর্ষক যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন, তার উল্লেখ করেই এ প্রবন্ধের ইতি টানছি। উক্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়ঃ ‘আমরা সংবাদপত্রসেবীরা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে প্রধানতঃ তৎকালীন বাঙ্গালী মুসলমানদের সাংবাদিকতার পথ প্রদর্শকরূপেই দেখি।...
পরলোকগত (কমরেড) মোজাফফর আহমদ, বর্তমানে জীবন্মৃত কাজী নজরুল ইসলাম এবং অসংখ্য সাংবাদিকের স্রষ্টা প্রবীণ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কামাল সামসুদ্দিন সাহেবের ন্যায় অবিভক্ত মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার দিকপালদের কথাও আমরা কোনদিন ভুলিতে পারি না। এঁরা যদি হন আমাদের সাংবাদিকতার পীর, তবে মাওলানা আকরম খাঁ দাদা পীর। তাঁর অভোলা স্মৃতি ও তাঁর ঋণ ভুলিতে পারে এমন অকৃতজ্ঞ কে?’
সূত্রঃ সাহিত্য ত্রৈমাসিক “প্রেক্ষণ”, মাওলানা আকরম খাঁ স্মরণ, জুলাই-সেপ্টেম্বর-২০০৫।