অরুন্ধতী রায়ের মতো চিন্তকদের পক্ষ থেকে কিছু জোরালো যুক্তি রয়েছে যে, নয়া উদারতাবাদী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী এবং বিশেষত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ধর্মীয়-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে ভারতের আবির্ভাবের রহস্য নিহিত আছে।
ঔপনিবেশিকোত্তর সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচিত ভারতের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ভারতকে তার সেক্যুলার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে−অরুন্ধতী রায়ের মতো চিন্তকদের এমনটাই বিশ্বাস। হিন্দুত্ববাদের উত্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গণতন্ত্র−এগুলোর সবই খুবই গভীরভাবে সংখ্যালঘু, নিম্ন-বর্ণের হিন্দু ও বিরোধী মতকে বঞ্চিত করার সাথে যুক্ত। আর এটিই পালাক্রমে ভারতীয় ঐক্যের আদর্শিক ভিত্তি সেক্যুলারিজম ও বহুত্ববাদকে দুর্বল করে দেবে।
এটি একটি মজার বিষয় যে, নয়া-উদারতাবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর সম্প্রসারণের সাথে মুক্ত বাজারের রাজনৈতিক ত্রাতা হিসেবে চরমপন্থীদের আবির্ভাব সমানভাবে যুক্ত। অর্থনৈতিক উদারীকরণ, রাজনৈতিক চরমপন্থা এবং সাংস্কৃতিক সমজাতীয়করণ (cultural homogenization) এর যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভারত তার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। মোদী ডকট্রিনের দ্বারা একটা বদ্ধমূল বাতুল রাজনৈতিক প্রচারণা আছে যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবে এবং কর্পোরেট বিশ্ব তা সমর্থনও করে। ধর্মীয় নেতা, সরকার ও অর্থনীতির পুনর্মিলন বৈশ্বিক পুঁজিতন্ত্রের একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। এমন অবস্থা উন্নয়নশীল বিশ্বে ফ্যাসিস্টদের উগ্রজাতীয়তাবাদী ভোক্তা ও ব্র্যান্ড লিডার হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণে সহায়তা করে দরিদ্রদের অবস্থা আরো সঙ্গিন করে দেবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ‘ফাঁপা অর্থনীতির’ ভুয়া অহঙ্কার জারি রয়েছে তার ভঙ্গুর রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তির উপর। উত্তর-দক্ষিণের এলিটদের যোগসূত্র এবং আয় বৈষম্যের বিস্তৃতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তর্ভূক্তিমূলক (inclusive) মডেল নয়। দরিদ্র্যতা ও সমৃদ্ধির বিশ্বায়নের সাথে সাথে জাতিরাষ্ট্রগুলোর ভেতরে ও সীমানা জুড়ে অসমতা বেড়েই চলছে। সম্ভবত ভারত নয়াউদারতাবাদের জয়জয়কার (neoliberal triumphalism) ও ধনীদের জন্য উর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির অন্যতম মডেল অর্থনীতি। কিন্তু দরিদ্রসীমার নিচে বাস করা প্রায় ৮০ কোটি ভারতীয়ের জন্য এটি একটি ‘আবাসের অযোগ্য’ জায়গায় পরিণত হয়েছে। জীবনযাত্রার শোচনীয় মান, আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান হার, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিকাশ, বিদ্রোহের বয়ানে কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা এবং সম্পদের উর্ধ্বমুখী সঞ্চয়− এগুলোই ভারতীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে।
ভারতে উর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে। সেখানে জাতীয় সম্পদের ৮০ শতাংশই রয়েছে কর্পোরেট জায়ান্ট ও তাদের সম্পদশালী বন্ধুবান্ধবদের মালিকানায়। ভারতের সবচেয়ে বিত্তশালী কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রকফেলার ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের গৃহীত কৌশলগুলোই অবলম্বন করছে। অরুন্ধতী রায়ের মতে, ‘মার্কিন সরকারের ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অতীতে রকফেলার ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে’।
এই জোট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই গঠিত হয়নি। আদতে, এই ফাউন্ডেশনগুলো এবং মার্কিন গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার জোরালো প্রমাণ আছে যা ভারতে ডানপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের আরএসএস ব্র্যান্ডকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছে। সাফ্রন ব্রিগেডের আবির্ভাব এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হিন্দুত্ববাদের কোনো বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক বিবর্তনকে ফুটিয়ে তোলে না বরং তার পরিবর্তে, এটি অল্প ব্যয়ে কর্পোরেট স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যেই বিন্যস্ত হয়েছে।
কর্পোরেটদের স্পন্সর করা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে খুবই দক্ষতার সাথে মানুষের চিন্তা-চেতনার তদারকের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। কর্পোরেট মিডিয়ার বর্ণনায় যে চিত্র ফুটে উঠে সে অনুযায়ী, একজন ভারতীয় হওয়া মানেই হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রদের ও বেশিরভাগ ভারতীয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে যাওয়া, যাদের এই শোষণমূলক কর্পোরেট অর্থনীতিতে কোনো ধরণের প্রবেশাধিকার নেই। ভারতের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীও এই অর্থনৈতিক ট্রিকলডাউনের (economic trickledown) সুবিধা লাভ করে এবং এ কারনেই তারা কৃত্রিম ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে। নিম্নবর্ণের হিন্দু ও দরিদ্র, যারা সম্ভাব্য ভোটব্যাংকের শতকরা প্রায় আশিভাগ জুড়ে আছে, তাদেরকে মহান ভারতের মিথ্যা গরিমায় প্রলুব্ধ করার জন্য মোদি সরকার খুব ভালোভাবেই মুসলিমবিরোধী মন্ত্র ও কর্পোরেট অর্থ ব্যবহার করছে।
পাকিস্তানের বেশিরভাগ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতো, ভারতের ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’-ও (আরএসএস) তরুণদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব উস্কে দেয়ার জন্য বেশ কিছু স্কুল পরিচালনা করছে। এসব স্কুলগুলোতে পড়ালেখা করা বেশিরভাগ ছাত্রই নিজেদের দুর্দশা ও দরিদ্রতার জন্য ইসলামকেই প্রকৃত কারণ হিসেবে গণ্য করে। এই দেশকে মুসলিমদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তারা আরএসএসকেই তাদের ত্রাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
গত সপ্তাহে ইসলামাবাদের ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস) আয়োজিত একটি সম্মেলনে একজন দিল্লীভিত্তিক ভারতীয় সাংবাদিক বিজেপি নেতৃত্বাধীন অত্যাচার-নির্যাতন এবং ডানপন্থী রাজনৈতিক বয়ানের অভিজ্ঞতা হাতে-কলমে বর্ণনা করেছেন। সম্মেলনটির একজন প্যানেলিস্ট তাঁর পরিভাষায় ভারতের ‘মোদীময়’(“Modi-fied”) অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মোদী সমর্থিত হিন্দু মন্দিরগুলোর সম্পদ বৃদ্ধির মধ্যে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। কোনো ধরণের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়লে এই মন্দিরগুলো তাদের কাছে স্বর্ণের রূপে সংরক্ষিত থাকা কোটি কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দিয়ে মোদি শাসনকে অব্যাহত রাখার সক্ষমতা রাখে। রাজনীতি, ধর্মগুরু ও অর্থনীতির এই নতুন মেলবন্ধন ভারতের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক হুমকি।
ধর্মীয় পরিচয় আকারে হিন্দু ধর্মের উত্থান হচ্ছে একটি ঔপনিবেশিক বিনির্মাণ, কেননা কখনোই হিন্দু ধর্ম নামে ভারতে কোনো একক ধর্ম ছিলনা। বরং হিন্দ পরিভাষাটি একটি ভৌগলিক ধারণা যা সিন্ধু নদীবিধৌত অঞ্চলকে নির্দেশ করে। সিন্ধুনদ জুড়ে অঞ্চলগুলোকে বোঝানোর জন্য হিন্দ বা সিন্ধ শব্দ দুটিকে অদল-বদল করে ব্যবহার করা হতো এবং এই অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদেরকে বলা হতো হিন্দু বা সিন্ধু। সুতরাং, এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রত্যেকেই তার ধর্মীয় বিশ্বাস যাইহোক না কেন মূলত একজন হিন্দু। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে, হিন্দু ধর্ম বর্তমান সময়ে বিজেপির কল্পিত একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের সমার্থক পরিভাষায় পরিণত হয়েছে।
আরএসএস-এর রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও, ভারত একটি সম্ভাবনার দেশ। এর রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা এবং রয়েছে শান্তিপ্রিয় জনগণ। ভারত সবসময়ই বিভিন্ন ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচয়গুলোর একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়ে ছিলো, যেখানে শত শত শতাব্দীজুড়ে মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থান করেছে। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতাই ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর অংশ ছিলো। তখনই পরোক্ষ বৃটিশ শাসনের অধীনে আইনি ও রাজনৈতিক দ্বৈততার মধ্যে নতুন নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ের উন্মেষ ঘটে।
আজকের ‘পাকিস্তান’ এবং ‘ভারত’ হলো এই উত্তর-ঔপনিবেশিক আইনি ও রাজনৈতিক দ্বৈততা যার সাথে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে রয়েছে ধর্মভিত্তিক পরিচয়কে ব্যবহার করে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি। এটা বিশ্বাস করা ঠিক হবেনা যে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উদ্ভবের আগে এখানকার রাজনৈতিক অবস্থা খুবই চমৎকার ছিলো। তবে, ভারতে বসবাসরত জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যৌথ অভিব্যক্তি, শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যে ইতিহাস রয়েছে, তা অস্বীকার করা কঠিন। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতায় মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক বিভেদের তুলনায় ভারত ও পাকিস্তান তাদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগলিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি সামঞ্জস্যই খুঁজে পেতে পারে।
এই উপমহাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং রয়েছে কঠোর পরিশ্রমী জনগণ। এই অঞ্চলকে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত অংশে পরিণত করার জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয় দক্ষতা। কীসে আমাদেরকে উন্নয়নের উচ্চ সীমায় পৌঁছুতে দিচ্ছেনা, এমন প্রশ্নের জবাব উভয় পক্ষের ফ্যাসিবাদীদের রাজনৈতিক বিভাজনমূলক শ্লোগানের মধ্য দিয়ে কখনোই দেয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তানে কৌশলগত উপায় হিসেবে স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রই ধর্মীয় চরমপন্থীদেরকে ব্যবহার করেছে, সেটিই এখন ভারতের সাথে যারা শান্তি চায় তাদের অন্তরায় হচ্ছে। একই ব্যপার ভারতেও ঘটে চলছে।
আশ্চর্যজনকভাবে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও চরমপন্থী এবং ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলো ভারতীয় গণমাধ্যমের মূলধারার রাজনৈতিক বয়ান ও আদর্শিক উপকরণগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় চরমপন্থীরা কখনোই মূলধারার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি এবং সংসদে সবসময়ই তারা প্রান্তিক ভূমিকা পালন করেছে। একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে বসবাস করলেও পাকিস্তানের জনগণ কখনোই ধর্মীয় দলগুলোকে ভোট দেয়নি। ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র’ থেকে ইসলামবিদ্বেষী, ডানপন্থী রাজনৈতিক পরিসর গঠনের দিকে ভারতের দৃশ্যমান অভিযাত্রাকে আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্র ও কর্পোরেট বিনিয়োগগুলোর দ্বারা শক্তিশালী করা হয়েছে ফ্যাসিবাদীদেরকে একটি ভোগবাদী অর্থনীতির আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ।
প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনগণের হতাশাকে উসকে দিয়ে একে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার এই সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল ভালোই কাজে দিয়েছে। নয়া উদারতাবাদী অর্থনৈতিক মৌলবাদের বিশ্বায়ন ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং একই সাথে দরিদ্রদের জন্য বিপজ্জনক অর্থনৈতিক ফলাফল বয়ে নিয়ে এসেছে। আলোকিত ও প্রগতিশীল ভারতীয়দের এখনই সময় ফ্যাসিবাদী পরিণতি থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ‘হিন্দুত্ববাদী’ আদর্শের রাজনৈতিক প্রতিবয়ান বিনির্মাণ শুরু করা।
সূত্রঃ The News