গণহত্যার রূপে ইসলামোফোবিয়া: রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা

এপ্রিল ১৯, ১৯৪৩ সালে ‘ভারসাভা (Warsaw)  ঘেটো আন্দোলন’ শুরু হয়েছিলো ঘেটোর অবশিষ্ট বাসিন্দাদের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পে নির্বাসন প্রক্রিয়ার প্রতিরোধ-প্রয়াস হিসেবে। গুটিকয়েক আগ্নেয়াস্ত্র ও হাতে বানানো বোমায় সজ্জিত সাতশ পঞ্চাশেক লোকের এই বিদ্রোহ  এক মাসের মতো টিকেছিলো। এই প্রতিরোধ দমনের পর জার্মানরা পুরো ঘেটোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়, আর পর্যায়ক্রমে সকল বাসিন্দাদেরকে ডেথ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নয়া-নাৎসিরা ক্ষমতাবান জালেমের সহিংসতা ও জুলুমবিরোধী (এমনকি অসার) প্রতিরোধের মাঝে এক প্রকার নৈতিক সমতুল্যতা টানতে গিয়ে তর্ক উঠাতো যে ‘ভারসাভা ঘেটো বিদ্রোহ’ হলোকস্টকে যৌক্তিক বৈধতা দেয়।


আগস্টের ২৫ তারিখে, বর্মি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মোতাবেক, শত শত রোহিঙ্গা লাঠিসোটা, হাতে বানানো বিস্ফোরক ও কিছু আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেশ কয়েকটি পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে। এই সংঘাতে বারোজন বর্মি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও ডজনখানেক রোহিঙ্গা নিহত হয়। রেঙ্গুনের সরকার এই ঘটনাকে অজুহাত করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আরেক দফা রাষ্ট্র-পরিচালিত রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু করে । কোন সংবাদ বা বিশ্লেষণী মতামতে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংগ্রাম ও বর্মি সরকারের জুলুমের মাঝে কোন প্রকার কার্যকারণ সম্পর্ক দেখালে, তা প্রকারান্তরে বর্মি কর্তৃপক্ষ সমর্থিত জাতিগত নিধনেরই সহায়ক হয়ে উঠে।

 
রোহিঙ্গাদের উপরে এই জাতিগত নিপীড়ন কয়েক দশক ধরেই চলছে। তাদের নাগরিকত্বের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে; বিচ্ছিন্নকরণ প্রকল্পে দেশব্যাপী কয়েক ডজন গ্রামে তাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ভ্রমণের ক্ষেত্রে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে;  ইবাদতের জায়গাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, বিয়ের ক্ষেত্রে বাধানিষেধের সম্মুখীন হতে হয়েছে, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার খর্ব করা হয়েছে।  বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, ধর্ষন, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ , ও গণ উচ্ছেদ সহ বিভিন্ন নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা।

 
বর্মি নেত্রী, নোবেল শান্তিপদকপ্রাপ্তা এবং গণতন্ত্রের আইকন অং সান সু চি কেবল  চুপ থেকেছেন তা নয়; তিনি উৎপীড়ণের সংবাদগুলোকে “ভুয়া খবর” হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে সচেতনভাবে এই উৎপীড়নকে সমর্থন দিয়েছেন। “ভুয়া সংবাদ” পরিভাষাকে মূলত বিখ্যাত করেছিলেন ট্রাম্প;; সেই লোক যিনি আমাদের জন্য “মুসলিম ব্যান” পলিসি নিয়ে এসেছেন। শুধু এই পরিভাষা ব্যবহারই সুচির সাথে ট্রাম্পের সাদৃশ্য বহন করে তা নয়, এখানে আদর্শিক ঘনিষ্টতাও বিদ্যমান।     


২০১১ সালে আনার্শ ব্রাইভিক সত্তর জন নরওয়েজীয় সমাজতন্ত্রবাদীকে হত্যা করে। সে তার এই গণহত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা এভাবে দেখিয়েছে যে, এটা ‘মার্ক্সবাদী, মাল্টিকালচারালিস্ট, ও মুসলিমদের’ অপবিত্র ত্রিত্বের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের একটা অংশ। ঠিক এভাবেই ব্রাইভিকের শাদা আধিপত্যবাদী চিন্তাধারা শুধু বর্ণবাদ ও সেমিটীয়বিদ্বেষবাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়নি, বরং অন্যান্য অনেক অল্ট-রাইট (অলটার্নেটিভ ডানপন্থী) গোষ্ঠির আদলে ইসলামোফোবিয়ার মধ্য দিয়েও হয়েছে। তখন থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, ইসলামোফোবিয়া আর চরমপন্থী ডান ঘরানায় সীমাবদ্ধ নেই; এটি এখন সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছে।

 
ইসলামোফোবিয়া মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি কেবল একগুচ্ছ নেতিবাচক মনোভাবের সমষ্টি না। সুবিধা ও নিষ্ঠুরতার এই বিশ্বব্যবস্থা বিনির্মানে ইসলামোফবিয়া যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতেই এর মূল গুরুত্ব নিহিত। এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, অং সান সু চি মনে করেন রোহিঙ্গারা বহিরাগত সন্ত্রাসী। এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, ইন্ডিয়ার নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি সুচির সাথে রেঙ্গুনে মোলাকাত করেছেন যখন তার আর্মি রাখাইনে জাতিগত নিধন চালাচ্ছিলো, যে রাখাইনে রোহিঙ্গারা শতকের পর শতক ধরে বাস করে আসছে। এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, হত্যা, ধর্ষন ও নির্যাতনের সংবাদগুলোকে সুচি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন ভুয়া খবর হিসেবে। এই সুচি, মোদী, ও ট্রাম্প - এদের সবাই কথা বলছেন  ইসলামোফোবিয়ার ভাষায়।


বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্র প্রকল্পের যে সঙ্কট প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাকে সামাল দিতে জেনোফোবিক জাতীয়তাবাদীরা ইসলামোফোবিয়ার যে ভাষা ব্যবহার করছে এটি সে-ই ভাষা। নিছক মুসলিমদের অস্তিত্বই এই দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদী মুক্তি অর্জনের অসম্ভাব্যতার স্মারক হয়ে উঠেছে যারা কোন গোষ্ঠী বা দেশের ছোট মুঠোয় জায়গা করে নিতে পারবে না। জাতীয় মুক্তি ও পুনর্জাগরণের প্রকল্প প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদী উদ্দীপণার যে ব্যর্থতা তার জন্য  নিছক মুসলমানদের অস্তিত্বকেই দায়ী করা হচ্ছে। তো এই ইসলামোফোবিক দুনিয়ায় মুসলিমরা বর্বর বহিরাগত ছাড়া কিইবা হতে পারে যারা সভ্যতাকে নিছক তাদের অস্তিত্ব দিয়েই হুমকি দিয়ে যাচ্ছে?


জেনফোবিক আধিপত্যবাদের শক্তিশালী হওয়াটা ক্রমাগতভাবে মুসিলম বশীভূতকরণ প্রচেষ্টার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তে মুসলিমরা বিশ্বব্যাপী ট্রান্স-ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদ উৎরে যাওয়ার একটি সিগ্নিফায়ার হিসেবে পরিণত হয়েছে (ভাষাবিদ ফার্দিনান্দ দ্য স্যুসুরের ভাষ্যমতে, ‘সিগনিফায়ার’ যেই অর্থদ্যোকতা হাজির করে তার উপর ‘সিগনিফাইড’ তৈরী হয়  - অনুবাদক)। ট্রান্স-ন্যাশনালিজমের এই দাবীটা চিহ্নিত হয় (নৈতিকতার দিক থেকে) দ্বৈত আনুগত্য, পরদেশীতা, সীমানা-উত্তর সম্পর্ক ও সম্বন্ধ শীর্ষক চিহ্ন দিয়ে। সুতরাং জাতিরাষ্ট্রের অসম্ভব পূর্ণতার পথে বাধা হিসেবে, বিশ্বায়নের চিহ্নায়ক হিসেবে, এবং হোমোজেনাস সমাজের  আকাঙ্ক্ষিত সাদৃশ্যের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে বরাবর মুসলিমরা  প্রতিফলিত হচ্ছে। বিশ্বায়ন কর্তৃক সৃষ্ট অস্থিরতা ও নয়া-উদারনৈতিক যুক্তিকাঠামোর শাসনে বিশ্বব্যাবস্থার কাঠামোগত যে রূপান্তর তার উপর থেকে নজর সরিয়ে মুসলিমদের অস্তিত্বের উপর নজর আনা হচ্ছে। এই মুসলিমরা বর্তমানে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ডায়াসপোরা (Diaspora) কেননা  তাদেরকে কোন জাতিরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোন নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত পরিচয়ে ধারণ করতে পারেনা।      

 
জাতির শরীরে বাসা বাধা বহিরাগত বিষাক্ত উপাদানগুলো সারানোর প্রতিষেধক হিসেবে পরিণত হয়েছে ইসলামোফোবিয়া। মুসলিমরা হচ্ছে নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক কাঠামোতে (Ethnos) জনগণকে (Demos) ধারণ করার  চুড়ান্ত অক্ষমতার রূপক।

 
রাষ্ট্রনীতি আকারে ইচ্ছাকৃত নির্বিচার হত্যাকান্ড হিসেবে গণহত্যা ঘটে থাকে জাতি এবং ঐ সকল গোষ্ঠীর ছেদবিন্দুতে যারা জাতির সীমানা ভেঙ্গে দিয়ে সংকট তৈরী করে। ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে বিশ্বের সকল প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুসলিম সংখ্যালঘু রয়েছে যারা ‘হালের নৃতাত্ত্বিক-জাতীয়তাবাদের ধারা  এবং নাগরিকতা ও নৃতাত্ত্বিকতার  মাঝে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে তার সাথে জড়িয়ে পরেছে। বহুল আকাঙ্ক্ষিত নৃতাত্ত্বিকভাবে ‘বিশুদ্ধ জাতিরাষ্ট্র’ বাস্তবায়নের পথে তাই তাদেরকে প্রধান বাঁধা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

 
রোহিঙ্গাদেরকে তাদের আদিবাসস্থান গ্রামগুলো থেকে বিতাড়িত করে দেয়া হচ্ছে এবং হত্যা করা হচ্ছে কারণ তাদেরকে বিদেশী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে যারা বহিরাগত। ইসলামোফোবিক দুনিয়ায় মুসলিমরা কোথাও-ই  থাকার যোগ্য নয়। জাতিগত বিভাজনের উপর ভিত্তি করে  যে বিশ্বব্যবস্থা  গড়ে উঠেছে, বৈশ্বিকভাবে মুসলিম আইডেন্টিটির উত্থান এক্ষেত্রে সীমালংঘন হিসেবে পরিণত হয়েছে; সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তার আন্দোলনগুলোর চোখে তারা পাপী; এনলাইটেনমেন্ট টেলিওলজির চোখেও তারা পাপী।

 
ইসলামোফোবিয়া শুধু মুসলিমদের প্রতি বৈরীভাব নয়, বরং এটি হচ্ছে সেই আঠা যা এমন একটি জোটকে একসাথ করে রাখছে যারা বিশ্বকে আরো প্রশস্ত একটি সহাবস্থানের জায়গা হিসেবে গড়ে উঠতে বাঁধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উপর চালানো জাতিগতনিধন তাই নিতান্তই দুরবর্তী কোন ছোট সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ নয়। বার্মার জঙ্গলে যা-র উপরে হামলা করা হচ্ছে, তা আরেক প্রকার নয়া দুনিয়ার সম্ভাবনার  উপরেই হামলা।  

উৎসঃ DailySabah

২৯১

বার পঠিত

সালমান সায়্যিদ

সালমান সায়্যিদ তার প্রথম ডিগ্রী নিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের উপরে। এরপরে তিনি যথাক্রমে আইডিওলজি এন্ড ডিস্কোর্স এনালিসিসে মাস্টার্স, এবং গভর্মেন্টের উপরে ডক্টোরেট করেন। ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি নিলেও সালামান সায়্যিদ মূলত সোশিয়লজি ডিপার্টমেণ্ট মাড়িয়ে বেড়াতেন। ফলে তার মাঝে একটি ইন্টার ডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির প্রভাব দেখা পাওয়া যায়। প্রফেসর সালমান এখন ইউনিভার্সিটি অব লীডসের সোশাল থিওরি এন্ড ডিকলনিয়াল থটে শিক্ষকতা এবং রিসার্চ করেন। ডিকলনিয়াল থট, ক্রিটিকাল মুসলিম স্টাডিজ, ইসলামোফোবিয়া এন্ড রেইসিজম, হিস্টোরিকাল এন্ড রিলেশনাল মাক্রো-সোশিওলজি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি পিএইচডি সুপারভাইজ করে থাকেন, এবং সাধারনভাবে এগুলো নিয়েই কাজ করেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ ও গবেষণা প্রবন্ধঃ Books: Sayyid S, Islamism as Philosophy Decolonial Horizons (Bloomsbury Academic, 2015) Sayyid S, Recalling the Caliphate (London: Hurst Publishers, 2015) Law IG, Sian K, Sayyid S, Racism, Governance and Social Policy, beyond human rights, Routledge Advances in Sociology Series (London: Routledge, 2013) Sayyid S, Vakil A, Thinking Through Islamophobia Global Perspectives (Cinco Puntos Press, 2010) Sayyid S, Al-Khawf al-Uṣūlī: Al-Markaziyyat al-Ūrūbiyya wa Burūz al-Islām (Beiruit, Lebanon: Al-Farabi, 2007) Sayyid S, A Fundamental Fear: Eurocentrism and the Emergence of Islamism (Zed Book Ltd, 2003), 2nd Journal Articles: Sayyid S, ‘A measure of Islamophobia’, Islamophobia Studies Journal, 2.1 (2014), 10-25 Sayyid S, ‘The Dynamics of a Postcolonial War’, Defence Studies, 13.3 (2013) Tyrer D, Sayyid S, ‘Governing ghosts: Race, incorporeality and difference in post-political times’, Current Sociology, 60.3 (2012), 353-367 Chapters: Sayyid S, ‘Towards a Critique of Eurocentrism: Remarks on Wittgenstein, Philosophy and Racism’, in Eurocentrism, Racism and Knowledge: Debates on History and Power in Europe and the Americas and the Americas, ed. by Araújo M (London: Palgrave, 2015), 82-92 Sayyid S, ‘Khomeini and the Decolonization of the Political’, in Critical Introduction to Khomeini (Cambridge: Cambridge University Press, 2014)