রাবেয়া গানঃ শত বাঁধার আড়ালে তুই স্বাধীন ওরে ভাই

রাবেয়ার সেই জাগরণী শক্তি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, যা মানুষের মধ্যে নতুন একধরনের অদম্য শক্তি, চিন্তা এবং নতুন করে ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম দিয়েছে। প্রায় ৩০টি দেশের সচেতন মানুষেরা এই রাবেয়ার পতাকা, লোগো, স্লোগান এবং প্রতীকী চিহ্ন দ্বারা সকল ধরনের অন্যায়-অবিচার ও অসমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এটি বিশ্বব্যাপী মানুষেরমধ্যে অকল্পনীয় সাড়া জাগিয়েছে। জাতি, বর্ণ, মতবাদ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এই রাবেয়ার প্রতীকী চিহ্ন দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে এটি একটি নিজস্ব সুরের মূর্ছনার মধ্য দিয়ে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে রাবেয়া মুভমেন্টের মতই ছড়িয়ে পড়ে।

আর এই গানটির রচয়িতা হলেন মিশরীয় ইসলামী স্কলার ও চিন্তাবিদ প্রফেসর সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (মূলতঃ এটি  তাঁর একটি কবিতা থেকে নেয়া)। ১৯৫৪-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি মিশরের সবচেয়ে ভয়াবহ তোরা কারাগারে আটক ছিলেন যেখানে বর্তমানে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃবৃন্দ আটক আছেন।

একদিন সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ তাঁর সেল থেকে বাইরে বের হলে তাঁর পাশের সেল থেকে এক ব্যক্তি তাঁকে হাত ইশারা করে অভিনন্দন জানান। অপরিচিত ঐ ব্যক্তির শুভকামনায় আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে এই কবিতার চরণগুলি উচ্চারণ করেনঃ

শত বাঁধার আড়ালে তুই স্বাধীন ওরে ভাই
অন্তরীলে থেকেও রে তুই মুক্ত স্বাধীন, ভাই,

পরে তিনি এই কবিতার লাইন গুলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতায় রূপ দেন। আর এই কবিতার লাইনের অনেকগুলোই তাঁর সহযোগীরা তাঁর উদ্দ্যেশে আবৃত্তি করেন। এই কবিতাটি রচনার দুই মাস পর ১৯৫৭ সালের পহেলা জুন প্রিজন অফিসাররা ব্রাদারহুডের সদস্যদের উপর গুলী চালায় যার পরিণতি ছিল গণহত্যা। তাতে ২১ জন মারা যান, ২৩ জন আহত হন এবং ছয় জনেরও অধিক এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ দেখে আক্ষরিক অর্থেই তাদের মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলেন। আর এই সময় কারাগারের অন্যান্য ব্রাদারহুডের সদস্যদের কাছে এই কবিতাটি ছড়িয়ে পড়ে; যোগ করে ভিন্ন মাত্রা; বাড়িয়ে দেয় মানসিক দৃঢ়তা।

১৯৫৭ সালের ২৬ই জুন মিশরীয় পত্রিকা “মুসলিম ব্রাদারহুড” এর ২৯তম সংস্করণে পত্রিকাটির সম্পাদক এবং প্রফেসর সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের ছাত্র ইউসুফ আল-আজম এই কবিতাটি “From Behind Bars” এই শিরোনামে প্রকাশ করেন। এভাবে কবিতাটি প্রথমবারের মত প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে সমগ্র মিশর ও পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

দশ বছরের এই কারাজীবনে সাইয়্যেদ কুতুব তাঁর মাস্টারপিস পবিত্র কুরআনের ৩০ খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তাফসীর “ফী যিলালিল কুরআন” রচনা করেন । তিনি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান কিন্তু এক বছরের মধ্যে আবারও গ্রেফতার হন।

১৯৫২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নাসের সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলে ১৯৬৬ সালের ২৯ই আগস্ট তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়। তাঁর শহীদ হওয়ার পরবর্তী সময়ে তাঁর এই প্রভাব সৃষ্টিকারী কবিতা  “হে আমার ভ্রাতা, এই বন্দিশালার অন্তরালেই তুমি স্বাধীন” এবং তাফসীর খানি মুসলিম বিশ্বে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যা অগণিত হৃদয়কে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে।

মুসলিম বিশ্বে অতি পরিচিত এই কবিতাটি রাবেয়া স্কয়ারের ২০১৩ সালের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে সঙ্গীতের সুমধুর সুরে আবারও অন্যায়-অবিচার এবং অসমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের মধ্যে নব প্রাণের সঞ্চার ঘটালো।

মুসলিম বিশ্বে “You are Free My Brother”  সুরারোপিত এই গানটি আবারো নতুন রূপে ছড়িয়ে পড়লো। রাবেয়া প্রতীকের সেই অজ্ঞাত রূপকারের মতো এই কবিতাটির কম্পোজারও রয়ে গেছেন অজ্ঞাত। সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের কেউ একজন এই আবেদন সৃষ্টিকারী কবিতাটি কম্পোজ করে মুসলিম বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একদল যুবক তাদের তুর্কি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে এ গানটির নতুন এই অসাধারণ রূপটি দেন যেখানে কন্ঠ দিয়েছেন একজন সিরিয়ান কন্ঠশিল্পী।

মিশরীয় ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের কবিতা, মুসলিম বিশ্বের অজ্ঞাত কোন সুরকার, তুরস্কের বাদ্যযন্ত্র এবং সিরিয়ার কন্ঠশিল্পী- অসাধারণ এই মিশেল রাবেয়া স্কয়ারের স্পিরিটের সাথেও চমৎকার সামঞ্জস্যপূর্ণ। গানটির কয়েকটি পঙক্তি...

শত বাঁধার আড়ালে তুই স্বাধীন ওরে ভাই

অন্তরীলে থেকেও রে তুই মুক্ত স্বাধীন, ভাই,

আল্লাহকে যদি রাখতে পারো শক্ত হাতে ধরে।

 ক্রীতদাসের কুট মন্ত্রণা কীইবা করতে পারে?

তোমার গায়ে হীন জোয়ানে তীর ছুড়েছে তাই

গাদ্দারেরই অথর্ব হাত উঠেছে তোমার গায়

ভাঙ্গবে ও হাত ‘সবরে জামিল’ তোমার থাকা চাই

নেকড়ে দলের আবাস কিন্তু চিরস্থায়ী নয়।

দু’হাত, ও ভাই, রক্ত রাঙা ঝরছে অঝরে শক্ত বাঁধন,

হাত দুখানা নিথর তাই কিরে?

 মনে রাখিস এ কুরবানী আকাশ পানে ধায়

এই রক্তে তোর চিরস্থায়ী জীবন সুনিশ্চয়।

গানটির লিঙ্ক:

http://www.r4bia.com/content/r4bia-song

সূত্রঃ http://www.r4bia.com/