মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার কারণ কী? মিডিয়ায় আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন এটি হচ্ছে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে সুপ্রাচীনকাল ধরে চলে আসা সংঘর্ষেরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু বাস্তবতা মোটেই তা নয় বরঞ্চ এটি একটি মিথ। বাস্তবতা হচ্ছে এ সংঘর্ষ ক্ষমতার, ধর্মের নয়। এটি একটি সাম্প্রতিক ফেনোমেনা, সুপ্রাচীন নয়। এ ইতিহাস চল্লিশ বছরের, চৌদ্দশ বছরের নয়।
প্রকৃতপক্ষে এ সবকিছুর শুরু ৭০ এর দশকের শেষের দিকে যখন একদিকে সুন্নিপক্ষে পেট্রোশক্তি সৌদি আরব ও শিয়া পক্ষে বিপ্লবী শক্তি ইরানের উত্থান ঘটে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যখন ২০১১ সালে বাশার আল আসাদ সিরিয়াতে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অতএব এ সবকিছুর মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রাজনীতি।
স্মরণ রাখুন সিরিয়া সংকটের শুরু কোন সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে নয়; এটি ছিলো নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণদের বিক্ষোভ। এটি ছিলো আরব বসন্তেরই একটি অংশ।
আজকেও যখন রাশিয়া সিরিয়াতে বোমা বর্ষণ করছে তা এ কারণে না যে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রাসূলের পরে কে খলিফা হয়েছে তা নিয়ে তারা খুব চিন্তিত বরঞ্চ তাদের স্বার্থ পুরোপুরি ভূ-রাজনৈতিক। একই সময়ে শিয়া ইরান কর্তৃক আলাওয়ী আসাদকে সমর্থন প্রদানের কারণ কোন দীর্ঘ ধর্মতাত্ত্বিক বন্ধন নয় বরঞ্চ এর মূল কারণ ভূ-রাজনৈতিক; আর যাই হোক আসাদই এ অঞ্চলে তাদের একমাত্র আরব মিত্র।
আলাওয়ীদেরকে শিয়া চিন্তার শাখা হিসেবে বিবেচনার ইতিহাসও চল্লিশ বছরের বেশি পুরনো নয়। আরো লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ইরান যে কেবল শিয়া হিজবুল্লাহকেই সমর্থন দিয়ে আসছে তা না, গত দুই দশক ধরে সুন্নি হামাসকেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শিয়া-সুন্নি সংঘাতের ভালোই নমুনা। এবারে লিবিয়ার দিকে তাকান। এখানে শিয়া সুন্নি মুখোমুখি নয় বরঞ্চ লড়াইটা সুন্নি বনাম সুন্নির মধ্যেই।
এদিকে ইয়েমেনের সংকটটাকে এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন লড়াইটা সুন্নি সরকারপক্ষ এবং শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে। অথচ ইয়েমেনের শিয়াদের বলা হয় যায়দী এবং বিশ্বাসগত জায়গায় তারা সুন্নিদের কাছ থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত ইয়েমেনের ইউএস ডিপ্লোমেটিক ক্যাবল থেকে জানা যায় এই দুই সম্প্রদায়ের (যায়দী ও সুন্নি) লোকেরা প্রায় সময় একই মসজিদেই নামায আদায় করে এবং প্রায় একই ধরণের প্রথাই মেনে চলে।
অতএব সুন্নি-শিয়া সংঘাতের এই বয়ান প্রকৃতপক্ষে অলস, সরলীকৃত, সাদামাটা সাংবাদিকতার ফল ব্যতীত আর কিছুই নয়। মধ্যপ্রাচ্য সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে পশ্চিমা সরকারগুলোর যে দায় এ ধরণের সাংবাদিকতা কেবল যে সে দায় অস্বীকারের সুযোগ তৈরি করে দেয় তা-ই না বরঞ্চ এ জিনিসটিও এড়িয়ে যায় যে অধিকাংশ মুসলিমই সহাবস্থানে বিশ্বাস করে এবং ISIL ন্যারেটিভের সাথে একমত পোষণ করে না। ISIL হয়তোবা শিয়াদের হাতে পেলেই হত্যার পক্ষপাতী কিন্তু প্রায় সকল মুসলিমই এ ধরণের চিন্তার বিরোধী।
একতরফা সরলীকৃতভাবে বৈশ্বিক সুন্নি-শিয়া সংঘাতের বয়ান তৈরির মাধ্যমে শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যকার রাজনৈতিক মিত্রতা, আজীবন বন্ধুত্ব এবং এমনকি ব্যক্তিক পর্যায়ের ভালোবাসার গল্পগুলোকেও অস্বীকার করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য একটি জটিল জায়গা এবং সেখানে চলমান সহিংসতার কারণ যতোটা না ধর্মতাত্ত্বিক ভিন্নতা তার চাইতেও হাজার গুণে বেশি ক্ষমতা দখল, আইডেন্টিটি পলিটিক্স, গোত্রীয় বিভাজন, অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপজনিত। মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তা কোন ধরণের সুন্নি-শিয়া ধর্মযুদ্ধ নয়। কিন্তু আমরা যদি একে ভুলভাবে সুন্নি-শিয়া ধর্মযুদ্ধ আকারে বিচার করতে থাকি তবে তা একটি নিয়ন্ত্রণহীন, সমাধানহীন সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
সূত্রঃ Upfront, Al-Jazeera