শনিবার সকাল ৯টায়, তেলআবিবে হামাসের সামরিক শাখার নতুন রকেট J80 এর সাহায্যে প্রতিশ্রুত মিসাইল আক্রমণ দেখার জন্য ফিলিস্তিনীরা হেব্রনে ও পশ্চিম তীরের অন্যান্য শহরের ছাদে আশ্রয় নিল।
J80 এর J দ্বারা জাবারীর নামের আদ্যাক্ষর বুঝায় যিনি সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ডার ছিলেন। ইসরাইল কর্তৃক ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর জাবারীর হত্যাকাণ্ড এর আগের যুদ্ধের সূচনা করে। এটাই ছিল এই আন্দোলন কর্তৃক প্রতিরোধের প্রমাণ যারা বর্তমান সংঘর্ষের সূচনা না করলেও যেকোন ইসরাইলী আগ্রাসন মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবির বিপরীতে হামাস সবসময় জোর দিয়ে বলে আসছিল যে কারা ইসরাইলের তিনজন কিশোরকে অপহরণ ও হত্যা করল সে ব্যাপারে তারা অবগত নয়। এই তিন হত্যাকাণ্ডের অজুহাত দেখিয়ে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী গাজা উপত্যাকায় অভিযান চালায়। এই ধরণের হামলা (তিন কিশোর হত্যাকাণ্ড) হামাস কর্তৃক সংঘটিত করার কথা নয় কেননা হামাসের লক্ষ্য ছিল ইসরাইলে ফিলিস্তিনী বন্দীদের মুক্ত করার পথ সুসংহত করা।
অনেক ফিলিস্তিনীরাই বিশ্বাস করে নেতানিয়াহু অপহরণের ঘটনার বেশ কয়েক মাস আগ থেকেই হামাসের বিপক্ষে অভিযানের পরিকল্পনা করে আসছিল। ইসরাইলের সাথে সংলাপের অচলাবস্থা মাহমুদ আব্বাসকে হামাসের সাথে পুনরায় সুসম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী করে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবুজ সংকেত প্রদান ইসরাইলীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। নতুন ঐক্যমতের সরকার ভাঙ্গনের চেষ্টা ও গাজার হাজার হাজার কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ বন্ধের চেষ্টার পর গাজার আক্রমণ ছিল নেতানিয়াহুর শেষ চাল।
এটি আবারো একটি ধবংসাত্মক ভুল হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। গত শীত থেকে ইসরাইলীরা গোপনে মিশরের নতুন সামরিক নেতৃত্ব থেকে আসা বার্তা নিয়ে আলাপ করছিল এই মর্মে যে তখন ছিল গাজা আক্রমণ ও হামাসকে উৎখাতের উপযুক্ত সময়। কায়রো প্রশাসন যারা মিশরের ইতিহাসের প্রথমবারের মত নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে তারা গাজার উপর অবরোধ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল যেমনঃ ইসরায়লের অর্থনৈতিক এবং স্থল, সমুদ্র ও আকাশ অবরোধের সময় মিশর সীমান্তে রাফাহ্ ক্রসিং বন্ধ করে দেয় এবং সুড়ঙ্গ ধবংস করে দেয় যা ছিল ঐ সময় গাজাবাসীর চলাচলের একমাত্র পথ।
সবসময়ের মত ইসরাইল বিশ্ববাসীকে বুঝাতে চায় যে বিশ্ববাসী দেখছে গাজার সাধারণ মানুষের উপর ইসরাইলী মারণাস্ত্রের ধবংসলীলা- তারা (ইসরাইল) কেবল ইসরাইলের শহরগুলোতে হামাসের মিসাইল নিক্ষেপের পাল্টা জবাব দিচ্ছে। হামাসের সাথে ইসরাইলের শেষ চুক্তি মিশরের তখনকার প্রেসিডেণ্ট মুহাম্মদ মুরসির মধ্যস্থতায় সংঘটিত হয়েছিল। সেই থেকে হামাস কেবল নিজেরাই বিরত থাকেনি অন্য ক্ষুদ্র দলগুলোকেও ইসরাইলের নিয়মিত হত্যাকাণ্ড বা মিসাইল আক্রমণের বিপরীতে পাল্টা প্রতিরোধ থেকে বিরত রেখেছে। সবার অগ্রাধিকার ছিল অবরোধের সমাপ্তি, নতুন কোন যুদ্ধের সূচনা নয়।
ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ ঘরবাড়িতে বোমা বর্ষণ এবং নারী ও শিশু হত্যার সাফাই গাইছে এই যুক্তিতে যে হামাস এই সকল নারী ও শিশুকে মানবপ্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসরাইলী যুদ্ধবিমান প্রতিবন্ধী কেন্দ্রগুলোকেও রেহাই দিচ্ছে না। নিঃসন্দেহে এই হামলাগুলো যাকে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না তা এমনকি পাশ্চাত্যেরও অনেক কড়া ইসরাইল সমর্থকদের বিব্রত করছে।
যতই এই সামরিক অভিযান দীর্ঘায়িত হবে ততই এটি ইসরাইল এবং তার পশ্চিমা পৃষ্টপোষকদের যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সম্ভবত এইজন্য প্রেসিডেণ্ট ওবামা দ্রুতই যুদ্ধ বিরতির মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। হামাসের সাথে মনস্তাত্বিক বিরোধ সত্ত্বেও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগও একই প্রস্তাব দেন যিনি গাজায় হামাসকে উৎখাতের আশা পোষণ করার কারণে এবং ইসরাইলের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব যা তার মুখের ভাষায় ইসরাইলের আত্মরক্ষার নিরঙ্কুশ অধিকার রয়েছে এই মত ব্যক্ত করার কারণে নির্ভরযোগ্যতা হারিয়েছেন। ।
এখনো যেকোন মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার বড় সমস্যা হল মিশরের নেতৃত্বের অভাব যা এই ভূমিকা পালন করতে পারত। মিশরের বর্তমান প্রশাসন মোবারকের যেকোন সময়ের চেয়ে হামাসের প্রতি অধিক বিদ্বেষী। জাতিসংঘের শান্তির দূত টনি ব্লেয়ার মনে হচ্ছে মিশরের সাথে মধ্যস্থতার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছে কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রতি তার শত্রুতার বিভৎস রেকর্ড রয়েছে।
এখন পর্যন্ত হামাস মধ্যস্থতার ব্যাপারে তেমন কিছু বলছে না যদিও অসমর্থিত সূত্রে কাতার বা তুরস্ক মধ্যস্থতার ব্যাপারে ভূমিকা নেবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবুও এটি পরিস্কার যে যদি হামাসের দাবি বিবেচনায় নেওয়া না হয় তবে হামাস কোন মধ্যস্থতায় সম্মত হবে না। এই দাবির মধ্যে রয়েছে অতীতের চুক্তির শর্তসমূহ আবারো সক্রিয় করা যার কিছু শর্ত ইসরাইল নিয়মিতই অমান্য করেছিল এবং সামুদ্রিক আর আকাশপথের অবরোধ তুলে নেওয়া।
এই যুদ্ধ নিঃসন্দেহে অনেক জনগণের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধবংসযজ্ঞ নিয়ে আসবে। ইসরাইলের দিক থেকে ক্ষতির দিক হবে অনেকটাই মনস্তাত্বিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক। আগের মতই এটা সুনিশ্চিত যে এই যুদ্ধ হামাসের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিবে। এবং এটি সকল ফিলিস্তিনীদের মধ্যে নৈতিক ঐক্যের সূচনা করবে হোক সে গাজা, পশ্চিম তীর কিংবা বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তানী অভিবাসী। এটি নিকটবর্তী তৃতীয় জাগরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে যা হবে আল-কুদস ইনতিফাদা।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান