আমার যে কথা সেটা বড় কঠিন এবং আমি যখন বলি তখন আল্লাহর রহমতে কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। সেইজন্যে আমি যেটা পছন্দ করি না, সে সম্বন্ধে বলব, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকেও সমালোচনা করবো। বিশেষ করে Self Criticism বা আত্ম-সমালোচনা এবং নিজের সমালোচনা না করলে কোন জাতি প্রগতির পথে, সত্যিকার প্রগতির পথে এগুতে পারে না।
ইসলাম কেবলমাত্র ধর্ম নয়, ইসলাম একটা জীবনাদর্শও বটে। একথা অনেকে বলেছেন, এটা আল-কুরআনেও আছে এবং যাঁরা আজকাল এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন তাঁরাও বলেন। কিন্তু এর আসল তাৎপর্য় কি? এর অর্থটা কি? এ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। তার কারণ ইসলামকে সংকীর্ণ অর্থে দেখা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এটার মূল্য কমিয়ে দেয়া হতো। সাথে সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষাকেও একই পর্যায়ে দেখা হতো।
এই যে একটু পাশে সরিয়ে রাখার ভাব এসেছিল তার কারণ আমাদের পরাধীনতা। পরাধীনতার সঙ্গে অর্থের অভাব। অর্থের সাথে নিষ্ঠার অভাব; সবটুকু মিশিয়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যাতে করে আমরা সত্যিকার ইসলাম কি, বুঝতে পারি নি। এখন আমাদের বুঝে নিতে হবে আসলে ইসলাম বলতে আমি কি বলছি। থিওরিটিক্যালী অতি সহজভাবেই এটা বলা যায়। কিন্তু আসলে কি বলছি, সেটা বুঝে বলা দরকার। সেদিক থেকে আমি মনে করি যে, আজকের দিনের সম্মেলন একটা যুগসন্ধিক্ষণ- আমরা নতুন যুগের দিকে চলেছি আর ইসলামী শিক্ষার নবযুগ সূচিত হয়েছে। আমি আশা করি এর রূপায়ণের পথে যে বাধা সেটা কেটে যাবে। এই সব বাধার কতকগুলো কারণ আছে। যারা বাধা দেন তারা সব সময় বাধা দেওয়ার জন্য বাধা দেন না। তারা তিন কারণে বাধা দেন। প্রথমটি হচ্ছে, তারা বুঝতে পারেন না। দ্বিতীয় কারণ, এ রকম তো কখনো করা হয়নি তবে কেন করা হবে? এবং তৃতীয় কারণ হচ্ছে, কিছু কিছু ভেস্টেড ইন্টারেস্টে বা কায়েমী স্বার্থ থাকতে পারে।
কেই যদি সত্যিকারভাবে বাধা দেন, ইনশাআল্লাহ সে বাধা কেটে যাবে। সুতরাং রূপায়ণের পথে সে বাধা বড় বলে আমার মনে হয় না।
ইসলাম আমাদের জীবনে কী তাৎপর্য বহন করে?
এ ব্যাপারটা বুঝবার জন্যে আমি কিছু বলতে চাই। অতি সহজেই বলা যায় বিজ্ঞান মানে সিস্টেম্যাটাইজড নলেজ। কিন্তু এ তো আমি কিছু বুঝলাম না। সিসটেম্যাটাইজেশান একটা শব্দ, যা অভিধানে আছে। নলেজও অভিধানে আছে। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝলাম না। প্রথম কথা হচ্ছে যে আমাদের পরিবেশ ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। আমরা যে পরিবেশে থাকি, আমরা মনে করি সেই পরিবেশই শেষ কথা। আর আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গী থাকে আমরা মনে করি সেই দৃষ্টিভঙ্গীই সব কিছু। অর্থাৎ এক দিক হতে আমরা শিরক্ করছি। অর্থাৎ আল্লাহ্কে আমরা মেনে নিচ্ছি না, আল্লাহ্র দেয়া মূল্যবোধ- সেটাকেও মেনে নিচ্ছি না। আমরা মেনে নিচ্ছি আমাদের পরিবেশকে। আমরা পরিবেশের পূজা করছি। মুসলমান যে পরিবেশেই থাকুক না কেন, তার মনে থাকবে – আমি মুসলমান, আমি মুমিন। কিন্তু সেই ভাবটা আমরা রাখেতে পারছি না। সুষ্ঠু পরিবেশের দরকার আছে স্বীকার করি, কিন্তু পরিবেশকে পূজা করার ফলে এক ধরনের মুশ্রিক পয়দা হচ্ছে, যার ফলে যে ধরনের পরিবেশ সেই ধরনের পরিবেশে থাকাটাই যেন মুসলমান থাকা। এটাই শিরক্। এই শিরকের ভিতর আমরা পড়ে গেছি। এবং আর একটা কথা হচ্ছে যে, যে দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সমাজে ইসলাম সম্বন্ধে রয়েছে সেই দৃষ্টিভঙ্গীটাকেই আমরা মনে করছি ইসলাম। আমরা কোনদিন আল-কোরআনের আলোকে মিলিয়ে দেখিনি যে, এই দৃষ্টিভঙ্গীটাই ইসলাম কি না। অর্থাৎ এই আর এক ধরনের শিরকের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি।
শিরক্ মানে হচ্ছে আল্লাহর মূল্যবোধ, আল্লাহর একত্ব যা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। তৌহিদের অস্বীকৃতি থেকে যে মূল্যবোধ আসে সেটা হচ্ছে আসল শিরক্। মূর্তি পূজাটা শিরকের বাইরের প্রতিফলন মাত্র। কিন্তু শিরক্ আমরা হরদম করছি। আমাদের একথা সুষ্ঠুভাবে বুঝে নেওয়া দরকার যে, ইসলাম আমাদের সমাজে অনুপস্থিত; ইসলামের যে মূল্যবোধ সে মূল্যবোধ কি আমাদের আমলের মধ্যে রূপায়িত হয়েছে? যখন শাসন ব্যবস্থা চালায় তখন কি আমরা প্রকৃত ইসলামের কথা ভাবি? যখন আমি মুসলমান ব্যবসা করি, সেখানে কি ইসলাম আছে? তখন কি আমরা মুসলমান হিসেবে কাজ করি? আমি যখন শিক্ষক, তখন কি আমি মুসলমান হিসাবে কাজ করি? একেই বলা হয় এবসেন্টিজম অব্ ইসলাম। আমাদের সমাজ হতে ইসলাম এবসেন্ট বা অনুপস্থিত। সালাত তো খুব বড় জিনিস। কিন্তু ঐ সালাত যদি আমার আমলের মধ্যে ঢুকতে না পারে তাহলে ওটাতো আল্লাহর কাছে গ্রাহ্য হবে না। মুসলমানদের অবনতির আসল কারণ হচ্ছে- জীবন সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলাম অনুপস্থিত। আমাদের জীবনের সত্যিকার কাজ হতে ইসলাম পালিয়ে গিয়ে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। মসজিদেও ইসলাম অবশ্যই থাকবে, তবে সারা দুনিয়াটাই তো আমাদের মসজিদ।
দ্বিতীয় কথা আধুনিকতা। আধুনিকতা মানে কি? যারা আমরা ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা করি, তারা আধুনিকতার সংজ্ঞা দিই না। আমরা সব সময়ে এই আধুনিকতার খারাপ দিকটার কথা বলি। কিন্তু এই আধুনিকতার মধ্যে অনেক জ্ঞান আছে । এই আধুনিকতার মধ্যে অনেক হাতিয়ার আছে, এই আধুনিকতার মধ্যে অনেক বিজ্ঞান আছে- সেটা আমরা বলি না। সুতরাং ইসলামের দিক থেকে বলতে গেলে, এই আধুনিকতার মধ্যে যেমন অনেক খারাপ জিনিস আছে তেমনি আছে অনেক ভালো জিনিস। আধুনিকতার ভেতরে যে ভালো জিনিস আছে তাকে আমাদের আত্মস্থ করতে হবে, এবং আত্মস্থ করে নিয়ে ইসলামী সমাজে গ্রহণ করতে হবে ও নিজেদের কাজে লাগাতে হবে। সুতরাং আধুনিকতাকে যদি একপেশে করে আধুনিকতা মানেই খারাপ বলা হয়, (যেমন নাকি তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা বলে থাকেন- ধর্ম মানেই খারাপ) এটা চলবে না। এটা মনে করলে আমরা ক্রমে ক্রমে দূর্বল হয়ে পড়বো। শত্রুর যে হাতিয়ার সেটাকে আমাদের হস্তগত করতে হবে এবং আল্লাহর কাজে লাগাতে হবে। নইলে এই প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় আমরা মোটেও টিকে থাকতে পারবো না ।
আর একটা কথা বলি, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে বিজ্ঞান শিক্ষার মূল্য কি? শিক্ষার কথায় আমি পরে আসছি। সেটাই আমার শেষ কথা। তার আগে আমি বিজ্ঞানের কথা বলি। অনেকে হয়তো জানেন, ইসলামই একমাত্র দর্শন- ইতিহাসের দিক থেকে ইসলামই একমাত্র দর্শন যা বস্তুকে বিশ্লেষণ করতে বলেছে। ইসলাম বলে শুধু আল্লাহকে ইবাদত করলে পরিপূর্ণ ইবাদত হয় না। তুমি বস্তুকেও বিশ্লেষণ করো। এটাকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবে, এমন এক বৈচিত্র যার মধ্যে তুমি আল্লাহ্কে খুঁজে পাবে। এ জন্যেই দেখা যায় যে মুসলমানরা প্রাথমিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে খুব দ্রুত এগিয়ে গেলেন- মাত্র একশো বছরের মধ্যে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে তারা যখন তৌহিদের মূল্যবোধ বিস্মিৃত হলেন তখন তারা আবার পিছিয়ে পড়লেন। সেজন্য আমাদের একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা ও অন্যদিকে তৌহিদকেও সাথে রাখতে হবে। আমাদের এই বস্তুর সাধনা, এই সাইন্স-এ যা কিছু বিশ্লেষণ করি, যা কিছু গবেষণা করি, সব কিছু ইসলামের মধ্যে রয়েছে।
কিন্তু আমি কিভাবে এই জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রূপায়িত করছি সেটার উপর নির্ভর করবে আমি সত্যিকার ইসলামের পথে রয়েছি কি না, একটা ব্যালান্স বিটুইন সাইন্স এন্ড রিলিজিয়ন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়– সব সময়ে আমাদের মধ্যে রাখতে হবে। যদি তা না রাখতে পারি, তাহলে আমি খুব ভালো লোক হতে পারি, কিন্তু আমাদের এমন অবস্থা হবে যেন আমার কোন হাত নেইঃ হাত নেই শুধু বসে আছি। আর যদি আমার হাত থাকে, বিজ্ঞান থাকে, কিন্তু কোনদিকে যাবো, তা জানি না। আর দুটোকে যদি এক সঙ্গে মিলাতে না পারি, তাহলে আমাদের অনেক ক্ষতি হবে। অনেকে একথা তুলেছেন যে, চাঁদে মানুষ যাবে কি করে? চাঁদে যাওয়াটা ভয়ানক অনৈসলামিক ব্যাপার, কিন্তু আল-কোরআনে যে বলা হয়েছেঃ দিন-রাত্রি ও চন্দ্র-সূর্য তোমাদের তাবেদার করে দিয়েছি, সেখানে কিনা মুসলমানরা বলে চাঁদে যাওয়া যাবে না। চাঁদ আর কোন ছার, মি’রাজের কথা চিন্তা করুন। চাঁদে যাওয়া মুসলমানদের কাছে কিছুই নয়। সুতরাং এই সমস্ত কথা প্রচার করে ইসলামকে অবহেলিত করা শুধু অনুচিত নয়, রীতিমত অন্যায়।
অনেকের ধারণা যে, ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তন করলে বিজ্ঞান শিক্ষা বাদ পড়ে যাবে। আমি বলবো, বিজ্ঞান শিক্ষা বাদ দিলে সে ব্যবস্থা ইসলাম বিরোধী হবে। কারণ যথাযথ মুমিনের মন নিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ইবাদতের শামিল। এখন, ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে আমি আমার আলোচনা শেষ করতে চাই।
ইসলামী শিক্ষা কাকে বলে? আমি গত কয়েক সপ্তাহ টেলিভিশনে বলেছি যে, আমরা ইসলামী শিক্ষা চাই, ‘ধর্মীয়’ (তথাকথিত ধর্মীয়) শিক্ষা চাই না। ভয়ানক সাংঘাতিক কথা। অনেকে আমাকে ফোন করে বললেনঃ এটা কি? জনাব এ কি কথা বলছেন? ধর্মকে একেবারে ছেড়ে দিতে চান? আমি বললামঃ না। তথাকথিত ‘ধর্মীয়’ শিক্ষা বলতে যে শিক্ষা বুঝায় সে শিক্ষা আমি চাইনা। একটা গল্প বললে বুঝতে পারবেন। আমি বড় আনকম্প্রোমাইজিং লোক। একটা এডুকেশন কমিটিতে অনেকদিন আগে আমার পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। সাধারণভাবে রিলিজিয়াস এডুকেশন এর মানে হচ্ছে, কেউ একটু হৈ চৈ করছে, রেখে দাও একটা রিলিজিয়াস এডুকেশন। আলাদা একটা রিলিজিয়াস এডুকেশন রাখা দায়সারা গোছের কাজ। অর্থাৎ একটা শিশু কাঁদছে, অমনি একটা লেবেনচুষ বের করে তার মুখে পুরে দিলেন। অমনি সে চট চট করে খেতে লাগলো। একে ‘রিলিজিয়াস এডুকেশন’ বা তথাকথিত ধর্মীয় শিক্ষা বলে, কিন্তু ইসলামী শিক্ষা বলে না।
তাহলে ইসলামী শিক্ষা বলতে কি বুঝায়? ইসলামী শিক্ষা বলতে প্রধানতঃ বুঝায় ইসলামী মন তৈরী করা। আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না- হাদিস এবং কোরআন বাদ দিচ্ছি না। কিন্তু আপনি যদি কাউকে হাদিস কোরআন পড়িয়ে দেন, কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী যদি তার মন মগজে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে সব কিছু ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেজন্য আমি প্রথমেই বলতে চাই, আল-কোরআনের শিক্ষা নিশ্চয় আছে ও ভিত্তি হিসেবে থাকবে। কিন্তু প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গীটা ইসলামী করে গড়ে তুলতে হবে এবং এজন্য যা যা করা দরকার, সেটাই হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার সমস্ত এলাকা ও পথ-নির্দেশ। এবং সেটাই যদি করে দিতে পারেন, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি আরবী পড়াতে পারেন, ফারসী পড়াতে পারেন, ফিকাহ্ পড়াতে পারেন, শরিয়ত পড়াতে পারেন, সব কিছু পড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু ইসলামী মন আপনি তৈরী করতে পারবেন না, যে পর্য়ন্ত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী আপনি প্রত্যেকের মানসপটে প্রতিফলিত করতে না পারেন। সেজন্যে তথাকথিত ‘ধর্মীয়’ (সংকীর্ণ অর্থে) শিক্ষা বলতে কিছু নেই। ইসলামী শিক্ষা আছে এবং সেই ইসলামী শিক্ষা আপনাকে দিতে হবে এবং ইসলামী শিক্ষা দিতে গেলে দুদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একটা দিক হচ্ছে একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা, একটা “ধর্মীয় শিক্ষা”, মাদ্রাসা শিক্ষা আর একটা সো-কল্ড সেকুলার সাধারণ শিক্ষা- এভাবে আলাদা রেখে দিলে চলবে না। এ দুটোকে এক করে একই ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু কি করে আনা যায় সেটাইতো মুশ্কিলের কথা। এর দুটো উপায় আছে।
এক হচ্ছে এই, মাদ্রাসাকে যদি মাদ্রাসার মতন রেখে দেন তাহলে হবে না, সেই রকম ইউনিভার্সিটি এবং কলেজকেও যদি আলাদা রেখে দেন, তাহলেও হবে না। কি করতে হবে? তুমিও একটু কাছে এসো আমিও একটু কাছে আসি। এটাই করতে হবে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়, এটা প্রথম। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, ইসলামী শিক্ষা মানে একটা বড় রকমের গ্লোরিফাইড মাদ্রাসা করে রাখবেন তাহলে ভুল করবেন। উভয়কে কাছাকাছি আসতে হবে। আপনি একটু আসুন, আমিও আসি। এটাই হবে ইসলামী শিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রতিষ্ঠা একটা বিরাট পদক্ষেপ। আমার মনে হয় এখানে এ ধরণের শিক্ষা হওয়া উচিতঃ আমি একটা উদাহরণ দিইঃ ‘মাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজী’ আমেরিকাতে আছে। সেখানে টেকনোলজী সম্বন্ধে পড়ানো হয়। কিন্তু ধর্ম শিক্ষাও সেখানে বাদ যায় না। —সোস্যাল সাইন্স পড়ানো হয়, সোসিওলজী পড়ানো হয়, পলিটিক্যাল সাইন্স পড়ানো হয়, সবকিছু পড়ানো হয়। কিন্তু তার জোরটা হচ্ছে টেকনোলজীর বিজ্ঞান। সেই রকম আমরা যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় করবো, এখানে আমরা সবকিছু পড়াবো। আগের দিনের মুসলমানরা সব কিছুই পড়তেন। কিন্তু তার মনটা যাতে ইসলামী হয় সেদিকে তাঁরা খোঁজ রাখতেন। আজকে আমি মনে করি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সব কিছু পড়ানো হবে। কিন্তু যেমন এম.আই.টিতে পড়ানো হয় টেকনোলজি বেশি করে, তেমনি এখানে ইসলামী আদর্শে উচুঁ দরের গবেষণার ব্যবস্থা থাকবে, সেটা আজকের দিনে টাকা পয়সার অভাবে, অবহেলার কারণে মাদ্রাসায় সম্ভব হচ্ছে না। সেইজন্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের বিশেষ বিভাগে উচুঁ দরের গবেষণা থাকবেই। নইলে এটাকে ইসলমী বিশ্ববিদ্যালয় নাম দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। এই হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ইসলামী শিক্ষার একটি দিক।
আর একটি দিক আছে। তা হলো অন্য যে সব বিশ্ববিদ্যালয় রয়ে গেল সেগুলো কি তবে আনইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। না, আনইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যদি নাকি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একই নীতির আওতায় নিয়ে আসতে পারেন। সেখানে তাহলে কি করতে হবে সে সম্বন্ধে বলছি।
সেখানে তিনটা জিনিস করতে হবে। একটা হচ্ছে, আগের দিনে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বাড়ীতেই মাওলানা সাহেব থাকতেন, যাঁর কাছে আমরা আরবী শিখতাম এবং ইসলামের প্রধান যে শিক্ষা সেটা শিখে নিতাম। আজকের দিনে বাড়ীতে মাওলানা রাখাটা আউট অব ফ্যাশান হয়ে গেছে। সেজন্য আমার মনে হয় যে, নীচের দিকে যে মক্তব এবং প্রাইমারি স্কুল আছে তাকে এক করে দেওয়া দরকার। এ দুটোর মধ্যে যে বিভেদ আছে তা না থাকাই ভাল এবং বিভেদ যদি না থাকে এবং সেখানে যদি সত্যিকারভাবে মাওলানা সাহেব দিয়ে ইসলামের দীনিয়াত ও ইসলামিয়াতের সবকিছু গোড়ার দিকে শিখিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার মনটা ঠিক ইসলামের পথে যেতে পারে। এটা প্রাথমিকভাবে করা উচিৎ। এর সঙ্গে আর একটা কথা আমি জুড়ে দিতে চাই। যেমন ইংল্যন্ডে ১৯৪৪ সালের শিক্ষা আইন-এ বলা হয়েছে যে, ধর্মীয় শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ইংল্যান্ডের কথা বলছি এই কারণে যে, সেখানে শিক্ষা আইন-এ বলা হয়েছে, ধর্মীয় শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ঐ আইন-এ আরো বলা হয়েছে যদি তারা এই শিক্ষা না শেখে তাহলে তার মা-বাবা দায়ী হবে। আমাদের দেশেও এ নিয়ম চালু করা উচিত। তাহলে অতি সহজেই বাড়ী থেকে যেমন তারা শিক্ষা পেয়ে গেল, তেমনি স্কুলেও শিখতে পাবে। আর একটা জিনিস করা দরকার। আমি ‘ইসলামী আদর্শ’ এই নামটা দিতে চাই। কারণ অনেকের মন ও মগজে নানা রকমের ভুল ধারণা আছে। আদর্শ বলে দিলে একটু সুবিধা হলো। মানে এতে আর বেশি কিছু বলা যায় না। কিন্তু ধর্ম– ওরে বাপরে বাপ। ভয়ানক খারাপ জিনিস। সুতরাং আদর্শ বলে দিলে কোন রকমে আস্তে আস্তে সামলে নিতে পারি।
আদর্শ বলতে শুধু রাজনৈতিক আদর্শ নয়– জীবনাদর্শ বোঝায়। ইসলামী আদর্শ বলে যদি একটা কোর্স প্রবর্তন করা যায়- ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে বি.এ এবং বি.এস.সি পর্য়ন্ত। কোর্সটি পরের দিকে আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে; এবং উপরের দিকে যখন যাবে তখন একু উচুঁ দরের কোর্সের দিকে যাবে। আরও একটু খুলে বলি । সাধারণভাবে ছোট ছেলেকে আদব শেখানো হলো, আল্লাহ্ এক- এটা শেখানো হলো। রসূলের (দ:) কথা সেখানো হলো। নবীদের কথা শেখানো হলো; কিন্তু একটু উপরের পর্য়ায়ে গিয়ে অনেকে বলেন, এ শিক্ষার দরকার নেই, কিন্তু আমি মনে করি এ কথা ঠিক নয়। কারণ একটা ছেলে নামাজ পড়তো, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়তো, খুব ভালো মুসলমান ছিলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এসেছে, অনার্স পড়ছে। এখন এমন ভাব হয় যেন এখন আর ওটার দরকার নেই। কারণ নামাজ পড়লে কেউ তো এখানে বাহবা দেয় না। সেজন্যে সে আর নামাজ পড়ে না। সুতরাং তার যে ঈমান, সে ঈমান ছিলো তার আব্বা ভালো বলেন, তাই। আল্লাহ্র উপরে ঈমান নেই। এখন আর আব্বা কাছে নেই। আব্বার ভালো বলবার দরকার নেই। তাই ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেওয়ার আরোও কারণ হলো এই যে, যখন তাকে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিখিয়ে দিলেন, মূল্যবোধ সব সময়ে পরির্তিত হচ্ছে, তাকে আরো শিখিয়ে দিলেন বিবর্তনবাদের মতে (বোধ হয় কথাটা মূল্যবান) মানুষ বানর থেকে এসেছে, তখন সে ভাবলো আব্বা তো শিখিয়ে দিয়েছিলেন মানুষ প্রথমে হযরত আদম (আঃ) থেকে এসেছে- এটা আবার কেমন কথা, কাজেই শেষেরটাই বোধ হয় ঠিক হবে। কারণ এখানে তো ঝকমকি অনেক বেশি। আমার আব্বাতো একটা ছেঁড়া পায়জামা পরে থাকেন, কি লুঙ্গি পরে থাকেন। তিনি একথা বলেছেন। আর এখানে তো বিশ্ববিদ্যালয়। এটিই হয়তো ঠিক হবে। সে জন্যে ঐ ছেলেটির কাছে একীভূত আদর্শের কোর্স যিনি পড়াবেন তিনি বিবর্তনবাদ এবং আমাদের যে থিওরী সেটা পড়িয়ে বুঝিয়ে দিবেন।
যিনি মূল্যবোধ পালটে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে বলেছেন, তার কথাটা সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য বুঝিয়ে দেবেন। তা না হলে তার ঐ সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর ঐ মৌলভি সাহেব ছোটবেলায় যা বলেছেন তার সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে এবং সংর্ঘের কোনই সংশ্লেষণ বা সিনথেসিস ঘটছে না। এতে ইসলামী মন গড়ে উঠতে পারছে না। কারণ যতদিনে ছেলেটি হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট, সি-এস-পি বা সেক্রেটারি হচ্ছে, ততদিনে সে ইসলাম বিরোধী হয়ে যাচ্ছে। কারণ, পরবর্তীকালে ইসলামী হওয়া লাগে না, সাফল্যের জন্যে আর ইসলাম লাগে না। সে জন্যে ইসলাম যেমন মূল্যবোধ থাকবে, তেমনি কিছুটা বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাও থাকা দরকার। তুমি বাবা, ইসলামী ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলে ভালো চাকুরী – বিশেষ করে বিভাগীয় প্রধানের চাকুরী পাবে না- এটাও বলে দেওয়া দরকার। আপনারা বলেছিলেন, যারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, মাদ্রাসায় পড়বে তাদেরকে অধিক বরাদ্দ, অধিক চাকুরী, অধিক স্কলারশীপ দিতে হবে। আমিতো আরো বেশি বলছি। যারা সাধারণ স্কুল কলেজে পড়ছে তাদেরকেও সত্যিকারভাবে ইসলামী শিক্ষা দিতে হবে।
এ পর্যায়ে আর একটা বিষয় আছে সেটা ইসলামী কারণ। আমি যে বিষয়ে পড়ি না কেন (আগেই বলেছি ক্লাস থ্রি থেকে বি.এ এবং বি.এস.সি অবধি ইসলামিক ইডিওলজি বাধ্যতামূলক হবে) ছোট ছোট কোর্স, যাতে বোঝা না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখে বইগুলো লিখতে হবে ভালোভাবে। আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি, শুধু কি মিস্ত্রি হবো? আমাকে মানুষ তো হতে হবে। সুতরাং আমাকে ইসলামের মূলকথা জানতে হবে। আমি একজন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হয়েছি, শুধু কি পদার্থবিদ্যা পড়াবো? আমাকে ইসলাম সম্পর্কেও জানতে হবে। এটা সব দেশেই আছে আপনি শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার কথাই বলেন কেন? ইংল্যান্ডে গণতন্ত্রের নিয়ম ভালো করে জানতে হয়। ইংল্যান্ডে সিটিজেনশিপ কোর্স আছে। সুতরাং একটু অন্য দেশের দৃষ্টান্ত দিই। আবার কি মনে করবেন, পেছনের দিকে বোধ হয় টেনে নিয়ে যাচ্ছি।
ইসলামী আদর্শ পড়ানো ছাড়াও আর একটা করণীয় আছে। সেটা হচ্ছে ধরুন, অর্থনীতির যিনি ছাত্র তিনি তো আগে থেকেই ইসলামের কিছু জানলেন। কিন্তু যখন অর্থনীতি পড়তে যাচ্ছেন তখন এ বিষয়ে ইসলামের কি বলা আছে, ইসলামী আদর্শের কি কথা আছে সেটা জানা আবশ্যক। এটা মনে করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে ইসলামিক পলিটিক্যাল থিওরীতে আমরা এম.এ তে একটা পেপার প্রবর্তন করি। আমি বলেছিলাম শুধু পলিটিক্যাল সাইন্স নয় সোশিওলজীতে, হিস্ট্রীতে, ফিলোসফিতে সমস্ত জায়গাতেই পলিটিক্যাল থিওরী অব ইসলাম, সোশিওলজীতে সোশিওলজীক্যাল থিওরী অব ইসলাম প্রবর্তন করা দরকার। তবে দিতে হবে খুব ভালোভাবে, খুব বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, খুব কায়দা করে, যাতে করে তারা আসল কথাটা ধরতে পারে। এভাবে আপনি যদি প্রত্যেক বিষয়ও দিয়ে দেন, তাহলে হবে কি? সে যখন সোশিওলজী পড়ছে তখন ইসলামিক সোশিওলজিটাও পাশাপাশি জানছে। এতে করে জীবন ও আদর্শ এক খাতে গিয়ে মিশবে। এটা ঐচ্ছিক বিষয় হলে চলবে না। কারণ আমার মনে যে কনফ্লিক্ট, যে সংঘাত আছে, সে সংঘাতের যদি কোন নিরসন না করতে পারি, তাহলে আমি চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে বেশিদূর এগুতে পারি না।
এখন পরিশেষে আর দুটো কথা বলে আমি শেষ করি। এই যে মাদ্রাসা শিক্ষার আন্দোলন- এটা সমগ্র সমাজের আন্দোলন, কোন একটি গ্রুপ বা পার্টির আন্দোলন নয় এবং সংকীর্ণভাবে এটাকে দেখা উচিত নয়। দ্বিতীয়তঃ একটা গ্লোরিফাইড মাদ্রাসা রাখবার জন্য ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন বা ইসলামী শিক্ষার পুনর্বিন্যাসের যে কথা, এটা তা নয়। আমরা অনেক ভুল করে ফেলেছি, তার কারণ হচ্ছে যে, এতদিন মুসলিম সমাজে যা কিছু আছে তাকেই আমরা ইসলামের শেষ কথা বলে মনে করেছিলাম। এ ভুলটা যেমন আমরা করি, তেমনি ইউরোপিয়ানরাও করে । ইউরোপিয়ানরা যখন বই লেখেন, তখন তারা বলেনঃ মুসলমান সমাজে এটা দেখে এলাম। সুতরাং সেটাই ইসলাম। কিন্তু এটা ভুল কথা। তেমনি আমাদের ইসলামী সমাজ সংস্কারকরাও ভুল করে থাকেন যে, মুসলমান সমাজে যা কিছু আছে সেটাই ইসলাম। কিন্তু সেটাতো ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে একটা আদর্শ। ইসলামী বা মুসলমান সমাজে যা কিছু ঘটছে সেটার সঙ্গে ইসলামকে একেবারে এক করে দেখলে চলবে না। ইসলাম সব সময়ে উপরে থাকবে। ইসলাম একটা আদর্শ। আদর্শটা সময়েই উপরে থাকবে। এটা আমাদের খেয়াল করা দরকার। তা না হলে হবে কি! যে সমাজ রয়েছে আমরা তাকে ইসলামের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে পারবো না। আমরা নতুন কিছু ভালো জিনিসও গ্রহণ করতে পারবো না। নতুন ভালো জিনিস, যেটা ইসলাম সম্মত, সেটা আমাদের গ্রহণ করতেই হবে।
দ্বিতীয়তঃ আমরা তো অনেক সময় ইসলামে যে সমস্ত ব্যাখ্যা আছে, সেই সমস্ত, ব্যাখ্যা ও মূলনীতিকে এক করে ফেলেছি। অর্থাৎ যাকে দর্শনে বলে, আমরা ইউনিভার্সাল এবং পার্টিকুলার কে এক করে ফেলেছি। মৌলিক নীতি এবং বিশেষ ব্যাখ্যাকে এক করে ফেলেছি। যেমন ধরুন, আমরা আইনের ক্ষেত্রে, শরীয়ত এবং ফিকাহ্কে এক করে ফেলেছি। শরীয়ত অনেক বড়ো জিনিস। ফিকাহ্ হচ্ছে একটা বিশেষ ব্যাখ্যা। অবশ্য আমি বলছি না যে, সব ফিকাহ বরবাদ করে দিতে হবে। বিশ্লেষণ করার সময়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ফিকাহ্ ব্যাখ্যা-তফসির। আর শরিয়ত হচ্ছে আসল জিনিস; সোজা পথ, মূলনীতি। শরিয়ত এবং ফিকাহ্তে একটা পার্থক্য নির্দেশ করা বিশেষ দরকার।
পরিশেষে বলি, ১৯৩০ সনে আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন যে, তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি ইসলাম সম্পর্কে নিরাশ নন। আমি ৪০ বছর পরে বলছি, আমি এমন এক ব্যক্তি যিনি ইসলাম সম্পর্কে শুধু যে নিরাশ নই তা নয়, বরং আমি মনে করি, ইসলামের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে সত্যিকারভাবে রূপায়িত করতে পারেন, কী অর্থনীতিতে, কী রাজনীতিতে, কী শিক্ষা ব্যবস্থায়, জীবনের প্রত্যেক চত্বরে জীবনের সব এলাকায় যদি এটা রূপায়িত করতে পারেন, তার দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে এবং আজকের দিনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে ও পরিবেশের দিকে খেয়াল রেখে, তাহলে দেখবেন আপনি আবার উপরে উঠে গেছেন। ইউরোপিয়ানরা এই পজিটিভ বা ইতিবাচক ইসলামকে খুব বেশি অপছন্দ করেন। কারণ যদি সত্যিকার পজিটিভ ইসলাম এসে যায় তবে তাদের আধিপত্যে ভাটা পড়বে। সেজন্যে তারা ইসলাম বলতে কোন একটা মুসলমান দার্শনিকের কথা বলে, কখনও অন্য কথা বলে, কি ঘটেছিল তা বলে। এটা ওটা বলে নানা রকমের দোষ দেখিয়ে দিয়ে এটা ইজ ইকুয়েল টু ইসলাম বলে শেষ করে দেয়। এর কারণ যে শুধু কু-সংস্কার তা নয়, এটা তাদের একটা ইচ্ছাকৃত পলিসি বা নীতি। অবশ্য পাশ্চাত্য দর্শন কেউ পড়বে না একথা বলছি না। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা যা লিখবেন সেটাই যে ইসলাম সম্পর্কে শেষ কথা নয়, এটা বুঝতে হবে।
এখন এমন এক যুগ এসেছে যখন আমরা আমাদের নিজেদের উল্লেখে বা রেফারেন্সে চলবো। বিশ্লেষণ করার সময় সবকিছুই কাজে লাগবে, কিন্তু আমাদের নিজেদের রেফারেন্সে, কোরান, হাদিসের রেফারেন্সে আমরা সব সময়ই চলবো। ইসলামের সত্যিকার সম্ভাবনা আসতে পারে যদি নাকি তৌহিদের উপরে আমরা জোর দেই, শিরক্- সব রকমের শিরক্ আমরা বাদ দেই, এবং জনকল্যাণের মাধ্যমে ইসলামকে আমরা রুপায়িত করি। আজকের দিনে মুসলমানদের এমন ভাব হয়েছে যে, তারা একেবারে শিথিল হয়ে গেছে; জড়োসড়ো ভাব, বিশেষ কিছু কাজ করতে পারে না। ইসলাম যখন আপনার জীবনাদর্শ, তখন আল্লাহ্র ওপরে আপনি নির্ভর করুন, আল্লাহ্র ওপরে ঈমান রাখুনঃ ‘হাসবি আল্লাহ্ লা ইলাহা ইল্লাহুয়া আলায়হি তাওয়াক্কালতু’- তাহলে জগতের কোন শক্তি নেই যে শক্তি আপনাকে পরাভূত করতে পারে। মুসলমান এমন জাতি– যে জাতি কোন বংশের জাতি নয়, যে জাতি কোন ভাষার জাতি নয়, যে জাতি কোন অঞ্চলের জাতি নয়, যে জাতি রাব্বুল আলামিনের জাতি। অর্থাৎ এটা সমস্তবিশ্বের আদর্শিক জাতি বা মিল্লাত। তারা এক আল্লাহর উপরে নির্ভর করছে এবং নীতি ও ইনসাফ জীবনে রূপায়িত করছে। এটাই হচ্ছে ইসলাম।
ইসলামকে যদি সত্যিকারভাবে জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা গ্রহণ করি, বিজ্ঞানের মাধ্যমে রূপায়িত করি এবং আল্লাহর উপর সত্যিকারভাবে নির্ভর করি, একীন রেখে নিষ্ঠার সাথে চলতে পারি, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তি নেই যা আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আমরা অনেক সময়ে একটু ঠেকে গেলেই আমাদের ঈমানে একটু ঘাটতি পড়ে যায়। এটা ঠিক নয়। আল্লাহ তো এমন জিনিস নন যে আমি দুটো কেক খেলাম – একটা কেক বড় ছিল, মাওলানা সাহেব দিলেন, আল্লাহ আছেন, মাওলানা সাহেব আর একদিন কিছুই দিতে পারলেন না, সুতরাং আল্লাহ নেই; এটাতো হতে পারে না। আমরা কিন্তু অনেক সময়ে এভাবে চলি। এক বন্ধুর পায়ে একটা ফোঁড়া হয়ে গেল, আল্লাহ্র কাছে তিনি বললেনঃ তাইতো আমার পায়ে ফোঁড়া হয়ে গেল কেন, আমিতো দিনে পাঁচবার নামাজ পড়েছিলাম; না আল্লাহ্টা বিশেষ সুবিধার নয়। কিন্তু দেখা গেল, এই পায়ে ফোঁড়ার কারণেই ভয়ানক গোলমালের সময় তিনি বাইরে যান নি- বাড়িতেই বসেছিলেন, বেচারা বেঁচে গেলেন। এটা তিনি প্রথমে বুঝতে পারেন নি। সুতরাং আল্লাহ্র কাছে, ভাল হোক এটাই আমার বলা উচিত। আমি এটা চাই, ওটা চাই বলা ভাল নয়। সেজন্যে আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে যদি আমরা এগুতে পারি ইনশাআল্লাহ্ আমরা সত্যিকার ইসলামী সমাজ কায়েম করতে পারবো এবং দুনিয়াকেও এ ব্যাপারে পথ দেখাতে পারবো। (১৯৭১ সালের ২রা আগস্ট মাদ্রাসা শিক্ষা সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ)
সূত্রঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃ্ক প্রকাশিত “ইসলামী শিক্ষা অগ্রগতির পথে” গ্রন্থ