বিদায়-হজ

হজযাত্রার ঘোষণা

কা’বাতুল্লার নির্মাণকার্য শেষ হওয়ার পর, আল্লাহ স্বীয় খলিলকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছিলেনঃ ‘তুমি লোকদিগের মধ্যে হজ সম্বন্ধে ঘোষণা করিয়া দাও, যেন তাহারা দেশের প্রত্যেক দূরপ্রান্ত হইতে পদব্রজে বা উষ্ট্রে আরোহণ-পূর্বক তোমার সন্নিধানে সমবেত হয় এবং নিজের কল্যাণপ্রাপ্ত হইতে পারে।’ মোছলেম জাতির ইহ-পরকালের সকল কল্যাণ ও সকল মঙ্গলকে পূর্ণ পরিণত করার জন্য, কুলপতি হযরত এব্রাহিমকে দিয়া এই ঘোষণাবাণী প্রচার হইয়াছিল। এতদিন পর এব্রাহিম বংশের উজ্জলতম রত্ন, তাঁহার প্রার্থনা- হযরত মোহাম্মদ মোস্তফার কঠোর সাধনার ফলে, এব্রাহিম খলিলের প্রতিষ্ঠিত সেই কা’বা, শের্কের কলঙ্ককলুষ হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হইয়াছে। মহামতি হযরত এছমাইলের জন্মভূমি আরব-উপদ্বীপ, আবার আল্লাহর নামের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। তাই সময় বুঝিয়া, দশম হিজ্বরীর শেষভাগে, সাধারণভাবে ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইল যে, হযরত এবার হজযাত্রা করিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন। এই ঘোষণাবাণী প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আরব-উপদ্বীপের প্রান্তে প্রান্তে আনন্দ, উৎসাহ ও উদ্দীপনার তরঙ্গ বহিয়া গেল। বহু মুছলমানের পক্ষে আজও হযরতের চরণ দর্শনের সৌভাগ্য ঘটিয়া উঠে নাই। তাঁহারা যুগপৎভাবে এই মহাপুণ্যার্জনের জন্যও ব্যা্কুল হইয়া উঠিলেন।

লক্ষ সেবক বেষ্টিত মোস্তফার হজযাত্রা

দশম হিজরীর জি-কা’দ মাসের পাঁচ দিন বাকী থাকিতে হযরত যথারীতি প্রস্তুত ও সজ্জিত হইয়া কাছ্ওয়া নামক বিখ্যাত উষ্ট্রীর উপর আরোহণ পূর্বক হজযাত্রা করিলেন। অসংখ্য মুছলমান মদীনা হইতেই হযরতের সঙ্গী হইয়াছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী ছাহাবী জাবের এবনে-আবদুল্লাহ বলিতেছেনঃ আমি প্রান্তরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, হযরতের অগ্রে-পশ্চাতে, দক্ষিণে-বামে যতদূর আমার নজর চলিল – লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে।[১] পথে যাইতে যাইতে আরও বহু গোত্রের যাত্রীগণ হযরতের সঙ্গে যোগদান করিলেন। ধনী-নির্ধন, ইতর-ভদ্র, দাস-প্রভু নির্বিশেষে সকল মুছলমান আজ একই আল্লাহর সেবক এবং এক আদমের সন্তানরূপে একই সাধন-ক্ষেত্রে সমবেশ হইয়াছে। এক একখন্ডের শুভ্র শ্বেতবর্ণের উত্তরীয় ও তহবন্দ, হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা হইতে মদীনার একটি দরিদ্রতম ক্রিতদাস পর্যন্ত, সকলের আজ এই একই পরিচ্ছদ। সকলেই নগ্নপদ, নগ্নমস্তক, সকলের মুখে একই ‘লাব্বায়েক’ ধ্বনি। এইরূপে লক্ষ সেবক বেষ্টিত মোস্তফা, ঠিক হিজরতের পথ ধরিয়া মক্কার দিকে অগ্রসর হইয়া নবম দিবসে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন।[২] ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে হযরতের এই যাত্রা সংক্রান্ত বিবরণগুলো বিস্তারিতরূপে বর্নিত হইয়াছে। আমরা নিম্নে তাহা হইতে এক্ষেত্রের আবশ্যকীয় কথাগুলি উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি।    

মক্কার নূতন  দৃশ্য

মক্কাধামে আজ এক অভিনব দৃশ্য দেখা দিয়েছে। সেই উপেক্ষিত, উৎপীড়িত সত্যের সেবক, দুই লক্ষ অনুরক্ত ভক্তের অনুপম জামাত সঙ্গে লইয়া, আজ আবার কা'বার সন্নিধানে সমবেত হইয়াছেন।  ছাফা-মারওয়া পরিক্রম এবং কা'বা প্রদক্ষিণ কালে, একই প্রকার শ্বেতবস্ত্র পরিহিত এই  বিপুল জনসমুদ্র, কখনোও ধীরে কখনও বা দ্রুত পদবিক্ষেপে, উপত্যকা-অধিত্যকা অতিক্রম করিতেছে – বিশাল সাগরবক্ষের ঊর্মিমালার মত সেই অনন্ত জনসাগরে তরঙ্গের পর তরঙ্গ খেলিয়া যাইতেছে। প্রত্যেক অধিরোহণ অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে, হযরতের বাণীর প্রতিধ্বনি করিয়া দুই লক্ষ কণ্ঠে রহিয়া রহিয়া ‘লাব্বায়েক’ নিনাদ ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে। ফলে আজ আবার আল্লাহর নামের জয়জয়কারে মক্কার গগণ-পবন পুলকিত, প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল, কা’বার প্রান্তরে প্রান্তরে রোমাঞ্চ জাগিল, স্বর্গের পূণ্যাশীষ সহস্রাধারে নামিয়া আসিল।

অসাম্যের প্রতিবাদ

কোরেশ পুরোহিত ও যাজকজাতি, ধর্মানুষ্টানেও তাহারা নিজেদের পৌরহিত্যপর্ব অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করিয়াছিল। এই জন্য তাহারা নিয়ম করে যে, কোরেশ ব্যতীত আর সকলকেই নির্বিশেষে – বিবস্ত্র হইয়া কা’বার তাওয়াফ করিতে হইবে। তবে তাহারা অনুগ্রহপূর্বক কাহাকেও বস্ত্রদান করিলে সে সেই বস্ত্র পরিধান করিতে পারিবে। বিগত হজের সময়  এই নির্মম ও ঘৃণিত ব্যবস্থার মূলোৎপাটিত করা হয়। এই সঙ্গে সঙ্গে তাহারা নিয়ম করিয়াছিল যে, কোরেশগণ হরমের অন্তর্গত মোজদালেফায় অবস্থান করিবে; আর অ-কোরেশ অকুলীন জনসাধারণকে যথাপূর্বক আরাফাতের ময়দানে সমবেত হতে হইবে। পান্ডা-পুরোহিত ও প্রপীড়িত জনসাধারণ এই ব্যবস্থা স্বীকার করিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিল। প্রথম দি্নই হযরত এই কঠোর প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, তিনি কোরেশের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া আরাফাতের জনসাধারণের সহিত সম্মিলিত হইয়াছিলেন। আজ এই ব্যবস্থারও মূলোৎপাটিত হইয়া গেল। আল্লাহর সন্নিধানে সমস্ত মানুষই সমান – তাঁহার এবাদত-বন্দেগীতে, তাঁহার শাস্ত্র-শরিয়তে বিভিন্ন গোত্রের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা হইতে পারে না। যে ঘৃণিত অহংকার ও নির্মম অসাম্যবাদের উপর এই তারতম্যের ভিত্তিস্থাপন করা হইয়াছে, এছলাম তাহার সমর্থন করিতে পারে না। বরং ইহার মূলোৎপাটন করাই এছলাম ধর্মের প্রধানতম সাধানা। কুলপতি হযরত এব্রাহিম এই সহানুভূতি-শিক্ষা ও সাম্যের দীক্ষা দানের জন্যেই ‘ইতর-ভদ্র’ নির্বিশেষে আল্লাহর সকল সন্তানকে আরাফাত ময়দানে সমবেত হইবার জন্য আহবান করিয়াছিলেন। ইহা ছাড়িয়া দিলে হজের মূল উদ্দেশ্যই যে পন্ড হইয়া যায়। সকলকে এই সকল কথা উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিয়া হযরত সহযাত্রীদিগকে সঙ্গে লইয়া আরাফাতের দিকে অগ্রসর হইলেন। এছলাম গ্রহণের পর কোরেশেরও ভাবান্তর উপস্থিত হইয়াছে, কাজেই তাহারাও নিজেদের সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিয়া হযরতের অনুসরণ করিলেন।[৩]

হযরতের অভিভাষণ

এই হজ উপলক্ষে হযরত যে কয়টি[৪] খোৎবা দানে করিয়াছিলেন, এস্থলে তাহা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অশেষ পরিতাপের বিষয় এই যে, সম্পূর্ণ ও ধারাবাহিকরূপে ঐ খোৎবাগুলির উদ্ধার সাধনা আজ অসম্ভব হইয়া পরিয়াছে। হাদীছ, তফসীর ও ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তকের বিভিন্ন অধ্যায়ে ঐ অভিভাষণগুলি বিভিন্ন অসম্পূর্ণ অংশ বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। আমরা যথাসাধ্য যত্ন করিয়া এক্ষেত্রে আমাদের আবশ্যক মত ঐ বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে নিম্নে একত্রে বিন্যস্ত করিবার চেষ্টা করিলাম।

করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালার মহিমা কীর্তন এবং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পর হযরত সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ

হে লোক সকল! আমার কথাগুলি মনোযোগপূর্বক শ্রবণ কর। আমার মনে হইতেছে, অতঃপর হজতীর্থে যোগদান করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হইয়া উঠিবে না।[৫]

শ্রবণ কর। মূর্খতা-যুগের সকল কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ আমার পদতলে দলিত-মথিত অর্থাৎ রহিত ও বাতিল হইয়া গেল।[৬]

মূর্খতা-যুগের শোণিত প্রতিশোধ আজ হইতে বারিত, মূর্খতা-যুগের সমস্ত কুসীদ আজ হইতে রহিত। আমি সর্বপ্রথমে ঘোষণা করিতেছি, আমার স্বগোত্রের প্রাপ্য সমস্ত সুদ ও সকল প্রকার শোণিতের দাবী আজ হইতে রহিত হইয়া গেল।[৭]

এক জনের অপরাধের জন্য অন্যকে দণ্ড দেওয়া যায় না। অতঃপর পিতার অপরাধের জন্য অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলিবেনা।[৮]

যদ্যাপি কোন কর্তিত-নাসা কাফ্রী ক্রিতদাসকেও তোমাদিগের আমীর করিয়া দেওয়া হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদিগকে পরিচালনা করিতে থাকে, তাহা হইলে তোমরা সর্বোতভাবে তাহার অনুগত হইয়া থাকিবা - তাহার আদেশ মান্য করিয়া চলিবা।[৯]

সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করিও না। এই অতিরিক্ততার ফলে তোমাদিগের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে।[১০]

স্মরণ রাখিও, তোমাদিগের সকলকেই আল্লাহর সন্নিধানে উপস্থিত হইতে হইবে, তাঁহার নিকট এই সকল কথার ‘জওয়াবদিহি’ করিতে হইবে। সাবধান! তোমরা যেন আমার পর ধর্মভ্রষ্ট হইয়া যাইয়ো না, কাফের হইয়া পরস্পরের রক্তপাতে লিপ্ত হইও না।[১১]

দেখ, আজিকার এই হজ দিবস যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ, মক্কাধামের এই হরম যেমন পবিত্র; - প্রত্যেক মুছলমানের ধন-সম্পদ, প্রত্যেক মুছলমানের মানসম্ভ্রম এবং প্রত্যেক মুছলমানের শোণিতবিন্দুও তোমাদিগের প্রতি সেইরূপ মহান – সেইরূপ পবি্ত্র। পূর্বোক্ত বিষয়গুলির পবিত্রতার হানি করা যেমন তোমরা প্রত্যেকেই অবশ্য পরিত্যা্জ্য ও হারাম বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাক, কোন মুসলমানের সম্পত্তির, সম্মানের এবং তাহার প্রাণের ক্ষতি সাধন করাও তোমাদিগের প্রতি সেইরূপ হারাম - সেইরূপ মহাপাতক।[১২]

এক দেশের লোকের জন্য অন্য দেশবাসীর উপর প্রাধান্যের কোনই কারণ নাই। মানুষ সমস্তই আদম হইতে এবং আদম মাটি হইতে (উৎপন্ন হইয়াছেন)।[১৩]

জানিয়া রাখ, নিশ্চয়ই এক মুছলমান অন্য মুছলমানের ভ্রাতা, আর সকল মুছলমানকে লইয়া এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ।[১৪]                                                                               

হে লোক সকল, শ্রবণ কর! আমার পর আর কোন নবী নাই, তোমাদের পর আর কোন জাতি (ওম্মৎ) নাই। আমি যাহা বলিতেছি, মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর, এই বৎসরের পর তোমরা হয়ত আমার আর সাক্ষাৎ পাইবেনা - ‘এলেম’ উঠিয়া যাওয়ার পূর্বে আমার নিকট হইতে শিখিয়া লও।[১৫]

চারিটি কথা, হাঁ! এই চারিটি কথা বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিও – শেরেক করিও না, অন্যায়ভাবে নর হত্যা করিও না, পরস্ব অপহরণ করিও না, ব্যাভিচারে লিপ্ত হইও না।[১৬]

হে লোক সকল, শ্রবণ কর, গ্রহণ কর এবং গ্রহণ করিয়া জীবন লাভ কর। সাবধান! কোন মানুষের উপর অত্যাচার করিও না! অত্যাচার করিও না! অত্যাচার করিও না! সাবধান, কাহারও অসম্মতিতে তাহার সামান্য ধনও গ্রহণ করিও না।[১৭]

আমি তোমাদিগের নিকট যাহা রাখিয়া যাইতেছি, দৃঢ়তার সহিত তাহা অবলম্বন করিয়া থাকিলে তোমরা কদাচিৎ পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইতেছে – আল্লাহর কেতাব ও তাঁহার রছুলের আদর্শ।[১৮]

হে লোক সকল! শয়তান নিরাশ হইয়াছে, সে আর কখনো তোমাদের দেশে পূজা পাইবে না। কিন্তু সাবধান, অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলিয়া মনে করিয়া থাক, অথচ শয়তান তাহারই মধ্যবর্তিতায় অনেক সময় তোমাদিগের সর্বনাশ সাধন করিয়া থাকে। ঐগুলি সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকিবে।[১৯]

অতঃপর, হে লোক সকল! নারীদিগের সম্বন্ধে আমি তোমাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছি – উহাদিগের প্রতি নির্মম ব্যবহার করার সময় আল্লাহর দণ্ড হইতে নির্ভয় হইও না। নিশ্চয় তোমরা তাহাদিগকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করিয়াছ এবং তাঁহার বাক্যে তাহাদিগের সহিত তোমাদিগের দাম্পত্যস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। নিশ্চয় জানিও, তোমাদিগের সহধর্মিনীগণের উপর তোমাদিগের যেমন দাবী-দাওয়া ও স্বত্বাধিকার আছে - তোমাদিগের উপরও তাহাদিগের সেইরূপ দাবী-দাওয়া ও স্বত্বাধিকার আছে। পরস্পর পরস্পরকে নারীদিগের প্রতি সদ্ব্যবহার করিতে উদ্বুদ্ধ করিবা। স্মরণ রাখিও, এই অবলাদিগের একমাত্র বল তোমরাই, এই নিঃসহায়াদিগের একমাত্র সহায় তোমরাই।[২০]

আর তোমাদিগের দাস-দাসী – নিঃসহায়-নিরাশ্র্য় দাস-দাসী! সাবধান! ইহাদিগকে নির্যাতন করিও না, ইহাদিগের মর্মে ব্যথা দিও না। শুনিয়া রাখ, এছলামের আদেশঃ “তোমরা যাহা খাইবে, দাস-দাসীদিগকেও তাহা খাওয়াইবে। তোমরা যাহা পরিবে, তাহাদিগকে তাহাই পরাইবে হইবে। কোন প্রকার তারতম্য করিতে পারিবে না।”[২১]

যে ব্যক্তি নিজের বংশের পরিবর্তে নিজকে অন্য বংশের বলিয়া প্রচার করে, তাহার উপর আল্লাহর, তাঁহার ফেরেশতাগণের ও সমগ্র মানবজাতির অনন্ত অভিসম্পাত।[২২]

আমি তোমদিগের নিকট আল্লাহর কেতাব রাখিয়া যাইতেছি। যাবৎ ঐ কেতাবকে অবলম্বন কইয়া থাকিবা – তাবৎ তোমরা পথভ্রষ্ঠ হইবে না।[২৩]

যাহারা উপস্থিত আছে, তাহারা অনুপস্থিতদিগকে আমার এই সকল ‘পয়গাম’ পৌঁছাইয়া দিবা। হয়ত উপস্থিতগণের কতক লোক অপেক্ষা অনুপস্থিতগণের কতক লোক ইহার দ্বারা অধিকতর উপকার প্রাপ্ত হইবে।[২৪]

হযরত এক-একটি পদ উচ্চরণ করিতেছিলেন, আর তাঁহার নকিবগণ বিভিন্ন কেন্দ্রে দণ্ডায়মান হইয়া অযুতকণ্ঠে তাঁহার প্রতিধ্বনি করিয়া যাইতেছিলেল। এইরূপে বিশাল জনসঙ্ঘের প্রত্যেক প্রান্তে হযরতের ‘পয়গাম’-গুলি প্রচারিত হইয়া গেল।

হযরতের বদনমণ্ডল ক্রমশঃই স্বর্গের পূণ্যপ্রভায় দীপ্ত এবং তাঁহার কণ্ঠস্বর সত্যের তেজে ক্রমশঃই দৃপ্ত হইয়া উঠিতেছে। এই অবস্থায় তিনি আকাশের পানে মুখ তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগি্লেনঃ “হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছি – আমি কি নিজের কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছি?” লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনি উঠিল – “নিশ্চয়, নিশ্চয়!” তখন হযরত অধিকতর উদ্দীপনাপূর্ণ স্বরে বলিতে লাগিলেনঃ “আল্লাহর শ্রবণ কর, সাক্ষী থাক; ইহারা স্বীকার করিতেছে। আমি আমার কর্তব্য পালন করিয়াছি। হে লোক সকল! আমার সমন্ধে তোমাদিগকে প্রশ্ন করা হইবে। তোমরা সে প্রশ্নের কী উত্তর দিবে জানিতে চাই। আরাফাতের পর্বত-প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিয়া লক্ষ কণ্ঠে উত্তর হইলঃ “আমরা সাক্ষ্য দিব, আপনি স্বর্গের বাণী আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, নিজের কর্তব্য সম্পূর্ণরূপে পালন করিয়াছেন।” হযরত তখন বিভোর অবস্থায় আকাশের দিকে অঙ্গুলি তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেনঃ “প্রভু হে শ্রবণ কর, প্রভু হে সাক্ষী থাক, হে আমার আল্লাহ সাক্ষী থাক!”[[২৫]

পাঠক! জাতীয় মহাসম্মেলনে – ধর্ম মহামণ্ডলের এই পূণ্যতম পূর্ণতম অধিবেশনে, শ্রেষ্ঠতম মানব, শ্রেষ্ঠতম সাধক এবং শ্রেষ্ঠতম রছুলের এই চরম ঘোষণাটি আর একবার পাঠ করুন। যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও আমরা বাংলা অনুবাদে হযরতের ভাবের গাম্ভীর্য ও ভাষার বিশেষত্ব অক্ষুণ্ন রাখিতে পারি নাই, বোধ হয় কেহই পারিবে না। এই সরল সহজ এবং স্পষ্ট অনাবিল পয়গামটির উপর টীকা-টিপ্পনি করার আবশ্যক নাই। আশা করি মুছলমান পাঠকগণ হযরতের এই চরম উপদেশের প্রত্যেক দফার সহিত সমাজের বর্তমান অবস্থা মিলাইয়া দেখিবেন।

নির্ঘণ্ট

[১] মো্ছলেম – ৩৯৫; আবু-দাউদ, জাদুল্-মাআদ।

[২] বোখারী, এবন-আব্বাছের বর্ণনা। এই যাত্রীদলের লোকসংখ্যা সম্বন্ধে ইতিহাসে কয়েক প্রকার মতের উল্লেখ আছে। ইহার মধ্যে নিম্নতম সংখ্যা ৭০ হাজার আর ঊর্ধ্বতম ১ লক্ষ ৪৪ হাজার। এই মতভেদের কারণ এই যে, মদীনা হইতে যাত্রার সময় লোকসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল, তাহার পর পথে ক্রমে ক্রমে ঐ সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। মক্কা প্রদেশের যাত্রীগণকে মিলাইলে ঐ সংখ্যা আরও বাড়িয়া যায়। বিভিন্ন রাবিগণ বিভিন্ন সময়ের অবস্থা বর্ণনা করায় এই প্রকার ‘মতভেদের’ সৃষ্টি হইয়াছে। অধিকন্তু এরূপ ক্ষেত্রে ঠিক সংখ্যা নির্ণয় করাও সম্ভবপর নহে। কেহ কেহ কোর্বানীর চামড়ার হিসাব করিয়া ১ লক্ষ ৪৪ হাজারের সমর্থন করিয়াছেন। ইহা গণনার প্রকৃষ্ট উপায়, কিন্তু বহু যাত্রীর সঙ্গে যে কোর্বানীর পশু ছিল না এবং তাঁহারা যে কোর্বানী করেন নাই, তাহা ত ছহী হাদীছ দ্বারাই প্রতিপন্ন হইতেছে। আমরা মো্টামুটি হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, সে বার সর্বসাকুল্যে ন্যূনাধিক দুই লক্ষ মুছলমান হজে উপস্থিত ছিলেন।
[৩] বোখারী, মোছলেম প্রভৃতি।
[৪] নববী দ্রষ্টব্য।
[৫] মা’দনুল-ওম্মাল ১১০৭ নং হাদীছ, তাবারী প্রভৃতি।
[৬] বোখারী, মোছলেম, আবু-দাউদ প্রভৃতি।
[৭] বোখারী, মোছলেম, আবু-দাউদ প্রভৃতি।
[৮] এবন-মাজা ও তিরমিজী প্রভৃতি।
[৯] মোছলেম।
[১০] এবন-মাজা, নাছাই।
[১১] বোখারী।
[১২] বোখারী, মোছলেম, তাবারী প্রভৃতি।
[১৩] একদুল-ফরিদ।
[১৪] হাকে্ম-মোছদরক, তাবরী প্রভৃতি।
[১৫] কানজুল-ওম্মাল, মছনদ-আবিওমামা।
[১৬] মোছনাদ-ছলমা-এবন-কায়েছ। শেষের দুইটি বরাত রেহলাতে-মুস্তফা ৫ম পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত।
[১৭] মোছনাদ-রক্কাশী - ঐ।
[১৮] বোখারী, মোছলেম ও ছেহার অন্যান্য পুস্তক।
[১৯] এবন-মাজা ও তিরমিজী।
[২০] বোখারী, মোছলেম, তাবারী প্রভৃতি। ইমাম নববী এই হাদীছের টীকায় লিখিতেছেনঃ নারী জাতির সদ্ব্যবহার ও তাহাদিগের স্বত্বাধিকারের বর্ণনা এবং তাহাদিগের প্রতি দুর্ব্যবহারের ভৎসনা বহু হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে। আমি ‘রেয়াজুজ-ছালেহীন’ পুস্তকে তাহার অধিকাংশই সংকলন করিয়াছি।
[২১] তাবকাত ২-১৩৩ প্রভৃতি।
[২২] মোছনাদ, আবু-দাউদ তায়ালছী ৫-১৫৪।
[২৩] বোখারী, মোছলেম প্রভৃতি।
[২৪] বোখারী।
[২৫] মোছলেম ১-২৯৭।

[উৎসঃ “প্রবন্ধসংগ্রহ” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে সংকলিত।]

সূত্রঃ খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত “প্রেক্ষণ” জুলাই-সেপ্টেম্বর ও অক্টবর-ডিসেম্বর-২০১০ (হজ্জ সংখ্যা) সংখ্যা।