মনীষী আলী মাজরুইঃ এক মহীরুহের স্মরণে (১৯৩৩-২০১৪)

মাজরুই আফ্রিকার ইতিহাস ও এর বর্তমান অবস্থার একটি ভিন্ন বয়ান হাজির করেছেন।

গত ৫০ বছর ধরে, আলী মাজরুই ২৬টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত বই এবং শতাধিক প্রবন্ধ, রচনা, সাক্ষাৎকার এবং রেডিও-টেলিভিশনে বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিতির মাধ্যমে আফ্রিকান স্টাডিজ এর জগতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। অক্টোবরের ১৩ তারিখে বিশ্ব একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীকে হারালো যিনি এক কঠিন সময়ে আফ্রিকার একাডেমিক এবং স্কলারলি বোঝাপড়াকে একটি কাঠামো দিয়েছেন যা আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাসের গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের বোঝাপড়াকে প্রভাবিত করেছে।

“Towards a Pax Africana" (1967) এবং "The Political Sociology of the English Language" (1975) এর মতো ক্ল্যাসিকের পাশাপাশি মাজরুই রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "The Trial of Christopher Okigbo" (1971)" (ক্রিস্টোফার অকিগবোর বিচার) শিরোনামের ইউটোপিয়ান উপন্যাস যার গল্প আবর্তিত হয়েছে স্বর্গজগতের সেটিংয়ে। তাঁর গবেষণার আগ্রহের বিষয় আফ্রিকার রাজনীতি হতে বিশ্ব রাজনীতির সংস্কৃতিসহ উত্তর-দক্ষিণ সম্পর্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। এসবের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহে- "Africa's International Relations" (1977), "Political Values and the Educated Class in Africa" (1978) এবং "The Political Culture of Language: Swahili, Society, and the State", গ্রন্থটির যৌথ লেখক ছিলেন আলামীন এম. মাজরুই। আরো দুইটি প্রভাবশালী গ্রন্থ হল- "A World Federation of Cultures: An African Perspective" (1976) এবং "Cultural Forces in World Politics" (1990)।

মাজরুই এর অবদান পর্যালোচনা করলে প্যান-আফ্রিকান, উপনিবেশবিরোধী এবং বহুজাতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গড়ে উঠা জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো পাই যা তাঁর স্কলারলি কাজকে একটি কাঠামো প্রদান করেছে। ১৯৬০ সালের পূর্বে আফ্রিকান স্টাডিজ উপনিবেশ এর বয়ান দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। মাজরুই এর মতো স্কলার এর জন্য আমরা ভিন্নভাবে আফ্রিকার ইতিহাস ও এর বর্তমান অবস্থা জানতে সক্ষম হই।

উপনিবেশবাদ এর গণ্ডী পেরিয়ে

তাঁর প্রবন্ধ "The Re-inventing of Africa"-তে মাজরুই এডওয়ার্ড সাঈদ এবং ভি.ওয়াই মুদিম্বী উভয়ের তুলনামূলক পাঠ-পর্যালোচনা করেন। একিসাথে যে উপাদানগুলো আফ্রিকার ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিলো সেগুলো নিয়ে তিনি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করেন। উপনিবেশবাদ এর গণ্ডী পেরিয়ে, মাজরুই আফ্রিকার ইতিহাস পর্যালোচনায় আরো তিনটি দিক আমলে নেন। সেগুলো হলো- ১। ক্লাসিক্যাল ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্ব ২। সেমিটিক লোকজনের সাথে আফ্রিকানদের সম্পর্ক এবং ৩। আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামের প্রভাব

মাজরুই কেনিয়ার মোম্বাসায় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কেনিয়ার শারিয়াহ্‌ কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন যা আইনানুযায়ী ইসলামি আইনের সর্বোচ্চ অথরিটি।

উপনিবেশবাদ পূর্ব সময়ে মাজরুই বংশই মোম্বাসা শাসন করে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ও প্রভাব বিস্তার করেছিল। মাজরুই যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন, নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ. ডিগ্রি নেন এবং সর্বশেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭৩ পর্যন্ত মাজরুই উগান্ডার কামপালায় অবস্থিত মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেন ডীন ছিলেন এবং পরবর্তীতে ইদি আমিনের কারণে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। এরপর তিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপনা শুরু করেন। সেখানে তিনি একিসাথে সেন্টার ফর আফ্রো-আমেরিকান এবং আফ্রিকান স্টাডিজ এর পরিচালক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি নিউইয়র্কের বিংহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের Albert Schweitzer Professor in the Humanities হিসেবে এবং Institute of Global Cultural Studies এর পরিচালক হিসেবে  মনোনীত হন। তিনি অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।

মাজরুই ছিলেন ব্যাপকভাবে পরিচিত একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। তিনি স্থানীয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার উত্থান-পতনের সাক্ষী যে ঘটনাগুলো আফ্রিকা ও মুসলিম বিশ্বকে প্রভাবিত করছিলো। আফ্রিকা মহাদেশের উপনিবেশবাদ বিরোধী বিপ্লবী সংগ্রাম মাজরুইকে লাখ লাখ মানুষের স্বপ্ন ও আশা উপলব্ধি করতে একটি সুনিপুণ পটভূমি সরবরাহ করেছিলো। যখন তিনি তাঁর পিএইচডি করছিলেন তখন তিনি বিবিসির একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন।

অবিরাম চ্যালেঞ্জ

তাঁর রেডিও কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থ খুবই স্বল্প সময়ে আফ্রিকান স্টাডিজকে নতুন কাঠামো প্রদান করে এবং মাজরুইকে এই বিষয়ের অথরিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। প্রথম বইটি ছিলো "Towards a Pax Africana" যেটির উদ্ভব তাঁর পিএইচডি থিসিস থেকে। এই গ্রন্থটির গুরুত্ব এখনো বিদ্যমান যা একটি বিউপনিবেশবাদী, ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত আফ্রিকার স্বপ্ন দেখায়। পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজের একাডেমিক স্বীকৃতির আগ থেকেই আলী মাজরুই লেখালেখি শুরু করেন এবং বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গিকে অবিরাম চ্যালেঞ্জ করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৮৬ সালে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি নয় পর্বের টেলিভিশন সিরিজ নির্মাণ করেন যার নাম "The Africans: A Triple Heritage" যা বিবিসি, পিবিএস এবং নাইজেরিয়ান টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে প্রযোজনা করে। এর মাধ্যমে মাজরুই ইংরেজী বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। সিরিজটি ডানপন্থীদের আক্রমণের শিকার হয় যাদের অভিযোগ ছিল এই সিরিজটি পাশ্চত্যবিরোধী এবং এই অজুহাতে এর পাবলিক ব্রডকাস্টিং এর ফান্ড কমানোর আহবান জানায়।

মাজরুই বেশ আগ থেকেই উত্তর-উপনিবেশিক যুগের আফ্রিকান কমিউনিজম এর সমালোচক ছিলেন। তিনি মনে করতেন এটি পাশ্চাত্যের আধিপত্যের আরো একটি রূপ মাত্র। অতিসম্প্রতি, মাজরুই আফ্রিকার নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করেন। আফ্রিকান লিবারেলিজম এর ধারণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি এ ধরণের পর্যালোচনা করেন যা তাঁর মতে আফ্রিকা মহাদেশ এবং এর বিচিত্র জাতিগোষ্টীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসরিত। অধিকন্তু, মাজরুই সমাজে ইসলামের ভূমিকা ও ইসলামপন্থার আবির্ভাব এর উপর গঠনমূলক বিশ্লেষণ দিয়েছেন এবং একিসাথে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমবর্ধমান সহিংসতাকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন।

মাজরুই ছিলেন একজন বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব যিনি পৃথিবীর কঠিনতম বিষয়গুলো মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্বকে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে তুলনা করেছিলেন এবং বর্ণবৈষম্য বিরোধী সংগ্রামের অগ্রগামী সমর্থক ছিলেন। তিনি শোষণকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের নিরন্তর সমালোচক ছিলেন। একিসাথে ইরাক এবং আফগান যুদ্ধসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সেনা হস্তক্ষেপ এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের তিনি নিরন্তর সমালোচক ছিলেন।

সূত্রঃ আল-জাজিরা

৫৯২

বার পঠিত

হাতেম বাযিয়ান

ড. হাতেম বাযিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠিত জাইতুনা কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ইসলামি আইন এবং ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ডিপার্টমেণ্ট অব নিয়ার ইস্টার্ণ স্টাডিজ এবং এথনিক স্টাডিজে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছেন। ড. বাযিয়ান ২০০২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন।

তিনি ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Islamophobia Research and Documentation Project-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সম্পাদনায় ২০১২ সাল থেকে Islamophobia Studies Journal প্রকাশিত হয়।

একাডেমিক কাজের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকায় কলাম লেখেন, যার মধ্যে রয়েছে আল-জাজিরা, ডেইলি সাবাহ এবং তার্কি এজেন্ডা।

তিনি American Muslims for Palestine এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান, Islamic Scholarship Fund এবং Muslim Legal Fund of America এর বোর্ড মেম্বার, Dollar for Deen Charity এর প্রেসিডেন্ট, Northern California Islamic Council এর চেয়ারম্যান।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ Jerusalem in Islamic Consciousness : A Textual Survey of Muslim Claims and Rights to the Sacred City (2006), Palestine,... it is something colonial (2016), Annotations on Race, Colonialism, Islamophobia, Islam and Palestine (2017)।