সালাফিরাই কি সহিংসতার জন্য দায়ী?

প্রবন্ধটি লিখেছিলাম প্রায় পাঁচ মাস আগে। কিন্তু পোস্ট করতে পারছিলাম না। কারণ, যখনই পোস্ট করতে চাচ্ছিলাম, তখনই আমার নিজেকে কিংবা আমার কোনো সহকর্মীকে তীব্র ‘সালাফি’ হামলার স্বীকার হতে হতো। যার ফলে মনে হতো, আমি যদি এটা পোস্ট করি তাহলে ওসব হামলার পেছনে যে সংকীর্ণমনা অন্ধত্ব আছে সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।

আমার যেসব সালাফি বন্ধু আছেন, কিংবা সালাফি যাদের সঙ্গেই আমার সম্পৃক্ততা আছে, তাদের ব্যাপারে গত কয়েকদিন আমি বেশ ভেবেছি। ইসলামের সেবায় তারা যে চমৎকার কাজ করে যাচ্ছেন সেগুলো নিয়েও চিন্তাভাবনা করেছি। সংকীর্ণমনা, উগ্র হওয়া ত দূরের কথা, বরং তাঁরা সম্মানযোগ্য, ন্যায্য মনমানসিকতার এবং ভারসম্যপূর্ণ নারী-পুরুষ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এবং ইসলামের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা অতুলনীয়। এমন একটি সময় যখন বিভিন্ন পক্ষ বা শক্তি চাইছে মুসলিমদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে এবং আমাদের একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সহিংসতায় লেলিয়ে দিতে, তখন আমি চুপ করে থাকার কোনো কারণ দেখছি না। উম্মাহ্র ঐক্য এবং পারস্পরিক কদর ও শ্রদ্ধার তাগাদায় আমি কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি।

ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি একের পর এক নেতিবাচক ধস নেমে আসছে। এর পেছনে রয়েছে মূলত ঠান্ডামাথার “জিহাদপন্থী” হত্যাকারীরা এবং মূলধারার প্রচারমাধ্যমে তাদেরকে ফাঁপিয়ে তোলা। মুসলিমদের তো বটেই, অধিকাংশ মানুষদেরকেই এসব প্রচারণা অস্থিতিশীল করে তুলছে। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন উত্তর ও সমাধান খোঁজাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত মরিয়া হয়ে যাওয়ার ফলে “জিহাদিপন্থী”দের সহিংসতার শেকড় বিশ্লেষণে ইতিহাস অবজ্ঞা করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।

এই অবজ্ঞা অনেক বেশি দৃশ্যমান যখন বোকো হারাম বা ISIS-এর উগ্র সহিংসতার পেছনে তাদের সালাফি সংশ্লিষ্টতাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তর্কটা যদিও সাধারণ এবং সুবিধাজনক, কিন্তু এ ধরনের সহিংসতার ব্যাখ্যায় এটা সঠিক বা বিস্তারিত আলাপ নয়। এই তর্ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে আড়াল করে দেয়।

নিজেদের “সালাফি” বলে দাবি করেন এমন অনেকেই ISIS, বোকো হারাম, আল-কায়েদা এবং তাদের সমগোত্রীয় বিভিন্ন দলের প্রচণ্ড বিরোধী। কিন্তু এই ইস্যুতে এমন সরল আলাপ সালাফিদেরকে নায্য সহমর্মিতা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে অবজ্ঞা করার পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

আমরা প্রত্থমেই শুরু করি বিংশ শতাব্দির অন্যতম প্রভাবশালী সালাফি ‘আলিম শাইখ মুহাম্মাদ নাসির আদ-দীন আল-আলবানীকে দিয়ে যিনি ছিলেন রাজনীতিবিমুখ। এটি বিশেষত সত্য ১৯৭৯ সালে ব্যর্থ মক্কা বিদ্রোহের পেছনে তাঁর পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার পর। এর পর থেকে তাঁর দা‘ওয়াহর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুসলিমদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলদের অর্থাৎ আস-সালাফ আস-সালিহদের আক্বিদা এবং ফিক্বহী কর্মপদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং তিনি যেগুলোকে ভিত্তিহীন এবং বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন সেগুলো থেকে ইসলামকে সংশোধন করা। তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের দৃষ্টিতে এই পৃথিবীতে মুসলিম ও ইসলামের বিজয় কেবল তখনই আসবে, যখন এই পন্থা অবলম্বন করা হবে, এবং একপর্যায়ে ঐশী সাহায্য আসবে। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ সালাফি এই পদ্ধতিকেই অনুমোদন দেয়।

অধিকন্তু, সালাফিদের আছে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক কর্মপন্থা বা মানহাজ। আল-আলবানী ও অন্যান্য সালাফিরা মুসলিম আক্বীদা ও আমলের মৌলিক বিষয়াদির উপরে জোর দেন। ফিক্বহী দিক থেকে কেউ কেউ তাঁদের কর্মপন্থায় দাউদ আয-যাহিরি ও ইব্ন হাজ্মের আক্ষরিকতাবাদের (literalism) ছাপ খুঁজে পান। এছাড়াও একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত শাফি‘ঈ মাযহাবেরও ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় যে ফিকহি মাযহাব থেকে দাউদ আয-যাহিরির উদ্ভব। অন্যরা হয়তো বলবেন, সালাফিদের কর্মপন্থা তুলনামূলক ফিক্হকেন্দ্রিক যা কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন মাযহাবের সিদ্ধান্ত থেকে দলিলের ভিত্তিতে যেটা সবচেয়ে শক্তিশালী সেটি গ্রহণ করে।

আক্বিদার দিক তাঁরা এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেন যা হাম্বলি অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। মহান (যদিও বিতর্কিত) হাম্বলি ‘আলিম ইব্ন তাইমিয়্যাহ যেসব সংশোধন করেছিলেন, সেগুলোতে বিশেষ জোর দেন তাঁরা। সুন্নি ইসলামের মধ্যে আশ‘আরি ও মাতুরিদিদের ব্যাপারে সালাফিরা বেশ সমালোচনামুখর। কিন্তু তাই বলে কিছু ব্যতিক্রম বাদে এটা অপর মুসলিমদের সাথে শান্তিপুর্ণভাবে ও সম্মানের সাথে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তাদের এই শ্রদ্ধার প্রমাণ পাওয়া যায় মহান সুফি আশ’আরি ‘আলিম ইব্ন ‘আতা আল্লাহ সাকানদারির সঙ্গে ইব্ন তাইমিয়্যাহর বিখ্যাত বিতর্কে। কিন্তু ISIS, বোকো হারাম বা তাদের মতো আরো যারা আছে, তারা ফিক্বহী ও আক্বিদাগতভাবে কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করেনি যেমনটা সালাফিরা করেছে। ফলে ইসলামের মৌলিক সূত্র বা পাঠ্যগুলোকে ইচ্ছেমতো তারা বিকৃত করার সুযোগ পায়। যার মধ্যে ঐতিহাসিক কোনো নজির তো থাকেই না, সমসাময়িক ‘আলিমদের অভিমতেরও প্রতিফলন পাওয়া যায় না।

কেউ কেউ হয়তো নির্দ্বিধায় বলবেন যে, সব সালাফি যেমন, আল-আলবানী সহিংস নয়। কিন্তু বোকো হারাম, ISIS, আল-কায়েদা এবং তাদের সমগোত্রীয়দের মধ্যে যেসব সহিংসতা দেখতে পাওয়া যায়, তার মূলে আছে সালাফি দীক্ষা। তারা হয়তো বলবেন, “সব সালাফি সহিংস চরমপন্থী নয়, কিন্তু সব সহিংস চরমপন্থীই সালাফি।” এটা ঠিক নয়। ISIS, বোকো হারাম ও সমগোত্রীয়দের সহিংসতা বেশ ভালোই প্রচার পায়। কিন্ত অন্যদিকে সিরিয়াতে আসাদের গদি ধরে রাখার জন্য আলাউই গুণ্ডাদের অপচেষ্টা, সিরিয়াতে বানের মতো ছড়িয়ে পড়া শিয়া হিজবুল্লাহ, কিংবা ইরাকে শিয়া মিলিশিয়া ও ডেথ স্কোয়াড যা অনেক ইরাকি সুন্নিদেরকে ISIS-এ যোগ দিতে বাধ্য করেছে- এরা সবাই ভয়াবহ সহিংসতায় লিপ্ত সেটা কমই গোচরে আসে। এগুলোর একটাকেও কোনমতেই সালাফি বলা যায় না। এই সকল দল ও গোষ্ঠীর সহিংসতায় জড়ানোর পেছনে সালাফিজমের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতা, বঞ্চনা, মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িকতা, নিজেদের অথবা মিত্রশক্তির অস্তিত্ত্বের প্রতি হুমকি ইত্যাদি কারণ অনেক গভীর ব্যাখ্যা দান করে।

এখানে আরও যোগ করা জরুরি যে, সব সহিংস চরমপন্থীই মুসলিম নন। এর প্রমাণ মেলে ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীর হামলা, হিন্দু ডেথ স্কোয়াড, গাজাতে ইজরায়েলি বাহিনীর নির্যাতন, রোয়ান্ডা ও কঙ্গোতে গোত্রীয় মিলিশিয়া, মেক্সিকান এবং কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ আমেরিকান মাদকচক্র এবং আরও অন্যান্য। এই ইস্যুগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে।

“জিহাদী”রা যেসব উগ্র সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে তার উৎস বুঝতে হলে আমাদেরকে সরল স্লোগানের উর্ধে উঠতে হবে। তাদের এই সহিংসতা বোঝার জন্য তাকফীর ইস্যু বোঝাটা জরুরি। সহজ ভাষায় তাকফীর হচ্ছে অন্য মুসলিমদের ধর্মচ্যুত করা; তারা আর ইসলামের মধ্যে নেই এমন ঘোষণা দেওয়া। বিপজ্জনক এই চর্চা কিছু মুসলিমকে অন্য মুসলিমের উপর কোনো প্রকার শাস্তি ছাড়াই সহিংস হামলার অনুমতি দেয়। এটা যদিও সত্য যে, সমসাময়িক ও ঐতিহাসিকভাবে কিছু সালাফিরা তাকফীর চর্চায় দোষী, কিন্তু এটা একচ্ছত্রভাবে কেবল সালাফি সমস্যা নয়।

ঐতিহাসিকভাবে এটা খাওয়ারিজদের বৈশিষ্ট্য। মুসলিমদের সহজেই ধর্মচ্যুত করার ক্ষেত্রে তাকফীর ইস্যুটির অপব্যবহার ও অতিমাত্রায় ব্যবহারকে স্পষ্টভাবেই বর্তমান সালাফিদের ঐতিহাসিক পূর্বসুরীরা এবং বর্তমান সময়ের অধিকাংশ সালাফিরাই প্রত্যাখ্যান করেন। অনেক মুসলিমই  ISIS-এর মতো গ্রুপগুলোকে আধুনিক সময়ের খাওয়ারিজ বলে মনে করেন। ঘটনা যখন এই, তখন সেসব সালাফিদের ব্যাপারে আমরা কী বলব, যারা খাওয়ারিজ ও ISIS উভয়কেই নিন্দা করেন এবং তাদের সহিংসতা ও যে বিশ্বাস তাদেরকে এই কাজ করতে অনুমোদন দেয় তা প্রত্যাখ্যান করেন?

সাম্প্রতিক সময়ে তাকফীরের অপব্যবহারের ক্ষেত্রে যারা অগ্রগামী তাদের কিছু অংশ নিজেদের সুফি হিসেবে চিহ্নিত করেন। যেমন, লেবাননের বিখ্যাত সুফি ধারা বা ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু সুফি ধারাসমূহ। এ প্রসঙ্গে এটা জানা জরুরি যে, জনপ্রিয় মুসলিম নাশীদ গায়ক জুনাইদ জামশেদকে কারা মুরতাদ ঘোষণা করেছিল, যে কারণে তাকে জীবন বাঁচানোর জন্য সাময়িকভাবে পাকিস্তান ছাড়তে হয়েছিল? সালাফিরা এটা করেনি। ISIS, বোকো হারাম এবং অন্যান্য “জিহাদি” গ্রুপগুলো তাকফীর করার ব্যাপারটিকে এমন চরম ভয়ংকর অবস্থানে নিয়ে গেছে, যা মুসলিমদের ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। অধিকাংশ সালাফিসহ প্রায় সকল মুসলিমই তাদের এই প্রান্তিক প্রবণতা প্রত্যাখ্যান করে।

“জিহাদী” সহিংসতার পেছনে দ্বিতীয় যে ইস্যুটি মদদ দেয়, সেটা হচ্ছে মানুষের জীবনের পবিত্রতার ধারণাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধবংস করে দেওয়া। নিষ্পাপ ও বেসমারিক লোকদের হত্যা করার ব্যাপারে ইসলাম স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এমনকি লড়াইয়ের ময়দানেও তাদের হত্যা করা যাবে না। যুদ্ধের ময়দানে সামরিক লোকদেরও প্রাণহানি যতটা কম করা যায় সে ব্যাপারে উৎসাহ দেয় ইসলাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের জীবনকে যে পবিত্রতা দান করেছেন, সেটা লঙ্ঘন না করার ব্যাপাারে হুশিয়ারি প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। আল্লাহ-প্রদত্ত জীবনের এই পবিত্রতা যখন হারিয়ে যায়, তখন সামরিক, বেসমারিক, যুদ্ধবন্দী, নারী ও শিশুর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। যুদ্ধের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায় যারা আচ্ছন্ন, এই বাস্তবতা তাদেরকে আঘাত করে। এই ইস্যুটা সালাফি ইস্যু তো নয়ই, ধর্মীয় ইস্যুও নয়। এটা মানবতার বিষয়।

জীবনের পবিত্রতার ধারণায় মানুষ তখনই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে যখন সে অন্যদেরকে মানুষের কাতার থেকে নিচে নামিয়ে আনে। এই বিশ্বাস যখন হারিয়ে যায়, তখন সে কোনো নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করে না, হত্যা করে একটা বস্তুকে যার জীবনের অধিকার নাই। স্টিভেন গ্রিন নামক একজন আমেরিকান সেনার চাঞ্চল্যকর ঘটনা বিবেচনা করা যাক। সে ইরাকি এক পরিবারকে হত্যার পর চৌদ্দ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করে। এরপর নিজের অপরাধ লুকানোর জন্য মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে দেয়। বিচারের সময় তার ভাষ্য, “এই লোকগুলোকে আমি যে কতটা ঘৃণা করতাম তা বলে বোঝানো সম্ভব না… এই লোকগুলোকে আমি মানুষ হিসেবেই ভাবিনি।” গ্রিন ও অন্যান্যরা ইরাকিদের যেভাবে স্রেফ পাগড়িপড়া আরবদস্যু হিসেবে দেখেছে তাদের সেই কর্মপন্থা এবং “জিহাদী”দের কর্মপন্থার মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু উভয়েরই অভিন্ন খাসলত হচ্ছে যুদ্ধ।

তৃতীয় ইস্যুটি যা মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ভয়াবহ সহিংসতায় ভূমিকা রাখছে তা হল ISIS-এর ইসলামের মৌলিক সূত্রগুলোর এমন এক অভিনব পাঠ যা বর্তমান সময়কে আখেরী যমানা বা শেষ সময় হিসেবে গণ্য করে। তবে এটা শুধু বর্তমান সময়ের সহিংস দলগুলোর একক বৈশিষ্ট্য নয়। প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে ইমাম আস-সুয়ুতির মতো অনেক প্রসিদ্ধ ‘আলিম আখেরী যমানা চলে এসেছে এমন দাবি করে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তাঁদের এবং ISIS-এর মতো গ্রুপগুলোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, ওরা যেভাবে এগুলোকে রাজনীতিকরণ করেছে, ক্ল্যাসিক বা সমসাময়িক ‘আলিমরা সেভাবে করেননি। ওরা ঐ ব্যাখ্যাকে উগ্র সহিংসতার সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছে।

ISIS-এর সহিংস আখেরী যমানার তত্ত্বকে সালাফি বিবেচনা করার জো নেই। কারণ এটা না পূর্বসূরি মুসলিম প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে, আর না এটা সমসাময়িক অধিকাংশ সালাফি ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। ISIS ও সমজাতীয় অন্যান্য দলগুলোর উত্থানের পেছনে যারা সালাফিবাদের মদদ খুঁজে পান, তাদের জন্য এটা মাথায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব দলগুলোর স্বতন্ত্র কিছু ধারণা ও প্রতিক্রিয়া আছে। এই গ্রুপগুলোকে সত্যিকারভাবে বুঝতে হলে ও এদের বিশ্বাস মোকাবিলা করতে হলে ওগুলো অনুধাবন করা জরুরি।

ISIS, বোকো হারাম, আল-কায়েদা এবং সমগোত্রীয় গ্রুপগুলোর সহিংসতার পেছনে সালাফি উৎস আছে বলে দাবি করাটা সহজ হলেও, তারা তাদের সহিংসতাকে মারাত্মক রূপ দেওয়ার জন্য অস্ত্র কোথা থেকে পায় সে উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। আল-কায়েদা ও তালিবানদের কারা অস্ত্রসস্ত্র ও অবকাঠামো দিয়ে রসদ জুগিয়েছে? উত্তর নাইজেরিয়ার একটি শহরে সীমাবদ্ধ বোকো হারামের মত ক্ষুদ্র একটি দল কীভাবে অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে নাইজেরিয়ান আর্মির চেয়েও বলীয়ান হয়ে উঠল? কারা তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে?

ISIS-এর ব্যাপারেও অনুরূপ প্রশ্ন তোলা যায়। অত্যাধুনিক এতসব অস্ত্রশস্ত্র তারা কোথায় পেল, যার বেশিরভাগই আমেরিকান? মসুলের পতনের পর তাদের হাতে এগুলো এসেছে এমন দাবি যথেষ্ট নয়। ভারী আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ৩০,০০০ ইরাকি সেনারা হালকা অস্ত্রে সজ্জিত মাত্র ১,৫০০-এর মতো ISIS যোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়ে কেন তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে গেল? উন্মুক্ত মরুভূমিতে ISIS-কে কেন এতসব অস্ত্র নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো, যেখানে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়াটাই ছিল সহজ। তাদের অস্ত্রমজুদের জন্য অর্থায়ন কে করে? আর কারাই বা তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে? এগুলোর উত্তর খুঁজলে তাতে অস্বস্তিকর সত্য বেরিয়ে আসবে। আর সেগুলো কখনোই সেসব তথাকথিত সাংবাদিক, পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করবেন না, যারা “জিহাদি” সহিংসতার উৎস নিয়ে খুব দ্রুত তর্কে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এই প্রশ্নের সঙ্গে আরেকটি প্রাসঙ্গিক ইস্যু রয়েছে। যেসব পরিস্থিতি এসব খুনে গ্রুপগুলোর উত্থানের চূড়ান্ত কারণ, সেসব পরিস্থিতি তৈরীর জন্য চূড়ান্তভাবে কারা দায়ী? দৃশ্যপটে “জিহাদি” খুনেদের আবির্ভাবের বহু আগ থেকেই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় সালাফিবাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু তারপরও প্রথমে পুরাতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে আমেরিকান বাহিনী যখন আফগানিস্তানে সামাজিক অবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে তার আগে সেই দেশে কোনো ইসলামিক জিহাদ ছিল না। ঠিক তেমনিভাবে ইরাকে আমেরিকার অভিযান ও দখলের আগে কোনো ISIS ছিল না। ২০০৯-এ বোকো হারামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইউসুফ ফাঁসিতে ঝুলানো এবং এর শ’ খানেকেরও বেশি অনুসারীদেরকে নাইজেরিয়ান সরকার হত্যা করার পর বোকো হারাম তাদের উন্মত্ততা শুরু করে। এসব গ্রুপের সহিংসতার পেছনে শুধু “সালাফিবাদ”-কে দোষারোপ করার আড়ালে মূলত সেসব কারণকে উপেক্ষা করা হয়, যেগুলো ঘৃণ্য এসব সহিংসতাকে উসকে দেয় এবং তা জিইয়ে রাখে।

মুসলিম বিশ্বের বহু অংশে আমরা যেসব সহিংসতা দেখছি, তার গোড়া খুঁজে বের করতে আরও অনেক বিষয় রয়েছে যা আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আসলে বর্তমানে আমাদের যে বিষয়টার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হচ্ছে জ্ঞানের বিরাট সংকট। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে দীক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাদের জানানো প্রয়োজন অন্য সম্প্রদায়ের লোকদেরকে মানুষের মর্যাদা থেকে নিচে নামিয়ে ফেলা, সহিংসতা, যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে আমাদের ধর্ম কী বলে। কাজটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি এবং চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। এজন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ একটি গোষ্টী যারা স্থিতি ও শান্তির প্রতি নিবেদিত সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

“জিহাদি”  সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে কেবল সালাফিবাদকে দোষারোপ করে আমরা বরং এই সহিংসতার গোড়ার কারণ এড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছি যা মুসলিম সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। সেই সাথে যারা নিজেদের সালাফি হিসেবে পরিচয় দেন এমন অনেক আন্তরিক ও সুমনা মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিও রয়ে যায়। এই সকল মুসলিম অন্যান্য মুসলিমদের মতোই কথিত “জিহাদি”দের বর্বর কাজের কারণে ক্ষুদ্ধ।

সূত্রঃ New Islamic Directions