রিচার্ড বুলিয়েট এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ইসলামি বিপ্লব ব্যতীত ইরান ঠিক পাকিস্তানের মতই একটি রাষ্ট্রে রূপ নিত। অর্থাৎ ইরানের শাসনভার থাকত কিছু এলিটদের হাতে, যারা বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার সাথে ইরানকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকত। এই অভিজাতগোষ্ঠী তখন একদিকে নিজেদের উদারনৈতিক ও আধুনিক হিসেবে পরিচয় দিত আর অন্যদিকে জনগণ তাদের শিক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুবিচার এবং অন্যান্য গণকাঠামোগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হত (বুলিয়েট, ২০১৭)। তাছাড়া শাসক এবং শাসিতের মধ্যকার ব্যবধান ক্রমে ব্যাপক আকার ধারণ করত। যার ফলশ্রুতিতে সহিংসতার প্রশ্নে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র বৈধতার ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ত। রিচার্ড বুলিয়েট তার এ আলাপে মূলত পাকিস্তান এবং তার প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সফলতা আর ব্যর্থতা পরিমাপ করার প্রশ্নে তুলনার জায়গাটি উল্টে দিয়েছেন। প্রচলিত রীতির বাইরে এসে তিনি প্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহকে তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক তুলনার বদলে সরাসরি পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অপরদিকে ইসলামকে তিনি কল্পনা করেছেন সমাজে অধিকতর সমতা আনায়নকারী শক্তি হিসেবে। আর এভাবে একইসাথে তিনি বেশ কিছু বিকল্প-বাস্তবতার সন্ধান এবং দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্লেষণ করবার ক্ষেত্রে নতুন কিছু মানদন্ড প্রদানের চেষ্টা করেছেন।
সাধারণত সাতচল্লিশ পরবর্তী উপমহাদেশকে ব্যাখ্যা করা হয় বিপরীত দিকে ধাবমান দুটি রাষ্ট্রের ইতিহাস আকারে; যেখানে একটি রাষ্ট্র সফল এবং অন্যটিকে ব্যর্থ মনে করা হয়। বাস্তবে পাকিস্তানের ব্যর্থতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক অতিরঞ্জন থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান যে সুপ্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল তার সঠিক বিকাশ আর হয়ে ওঠেনি। এই ব্যর্থতার কারণ নির্ণয়ে পাকিস্তান বিষয়ক ভাষ্যকার, এমনকি পাকিস্তানি নাগরিকদের মধ্যেও বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। তবে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা পাকিস্তানের ব্যর্থতার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয়, এমন কারণগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারি।
পাকিস্তানের ব্যর্থতা ব্যখ্যা করার চেষ্টা করে এমন অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হল- পকিস্তানে বিদ্যমান গণতন্ত্রের ঘাটতি। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এর শাসনতান্ত্রিক সংকটের কারণ; আর এই শাসনতান্ত্রিক সংকটই পাকিস্তানের যে কোন সামাজিক পরিবর্তনমূলক প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। এ রকম আরেকটি কারণ হল- রাজনৈতিক ইসলাম বা ধর্মীয় মৌলবাদ, যাকে দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আরো কিছু যুক্তি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে মূলত আর্থ-সামাজিক সমস্যাকে দেশটির সংকটাপন্ন অবস্থার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সমস্ত বিষয়গুলো মূলত পরষ্পর বিচ্ছিন্ন নয়; এবং এর বাইরেও আরো অনেক কারণ চিন্তা করা সম্ভব। তবে এ সমস্ত কারণগুলোর মধ্যে কিছু পূর্ব সংস্কারকে সাধারণ উপাদান হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর এ সমস্ত উপাদান মূলত প্রাচ্যবাদ (Orientalism) এবং তারই দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ ভারতবাদ (Indology) থেকে উৎসারিত।
এ সকল প্রভাবশালী বয়ান পাকিস্তানকে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি অসংগতি আকারে উপস্থাপন করে। পাকিস্তানের উপস্থিতিকে তাই সর্বদা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে হাজির করা হয়। মূলত এ সকল বয়ানে অখন্ড ভারতকেই এ অঞ্চলের চুড়ান্ত পরিণতি আকারে চিন্তা করা হয়; আর পাকিস্তানের সৃষ্টি যেন সেই ঐতিহাসিক পরিণতির পথে একটি বাধা। আর এই চিন্তার উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের অস্তিত্বকে একটি ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
এ সকল চিন্তায় ভারতীয় অখন্ডতা এবং তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুতির কারণেই যে শুধু পাকিস্তানকে অপাংক্তেয় ভাবা হয় তা না; বরং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্য চর্চার (practice) দিক দিয়েও পাকিস্তানকে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করা হয়। বস্তুত এ বয়ানগুলোতে দুটি প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে কাজ করে, যা একই সাথে পাকিস্তানকে ইন্ডিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্ব (যা পৃথিবীর চূড়ান্ত গন্তব্য বলে মনে করা হয়) থেকে আলাদা করে। মূলত তারা দাবি করেন যে, একটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেক কিছুই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। অথচ তাদের কল্পিত বৈশিষ্ট্যসমূহ, যা দিয়ে তারা পাকিস্তানকে মূল্যায়ন করেছেন, তার অনেক কিছুই যে ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানকাণ্ড থেকে উদ্ভূত— তা পর্যালোচনার তাগিদ তারা অনুভব করেন না। বরং এ সকল বৈশিষ্ট্যগুলোকে তারা বস্তুনিষ্ঠ এবং স্বতঃসিদ্ধ মনে করে থাকেন।
প্রাচ্যবাদের (Orientalism) নানামুখী সমালোচনা থাকা স্বত্ত্বেও, মোটাদাগে পাকিস্তান-সংক্রান্ত বিদ্যা এবং বিশেষত পাকিস্তান এর রাজনীতি সংক্রান্ত পর্যালোচনা এই সমালোচনার প্রভাব থেকে মুক্ত। প্রাচ্যবাদের সমালোচনা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা হল, এর সম্পর্ক কেবল জ্ঞানতাত্ত্বিক আলাপের সঙ্গে, বাস্তবিক বিদ্যার সাথে এর তেমন একটা প্রাসঙ্গিকতা নেই। আর ব্যবহারিক সুপারিশ (practical suggestions) প্রদানে তো এর প্রাসঙ্গিকতা আরো কম ভাবা হয়।
সাত দশক অতিবাহিত হলেও, ভারতবাদের পাকিস্তান-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ প্রাচ্যবাদের এ সকল পূর্বানুমানের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ রকম চিন্তার গন্ডি থেকে বের হওয়ার জন্য পাকিস্তানের ইতিহাসকে তাই পুনপর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তবে এ পর্যালোচনাকে কেবল ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে উত্তরণের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসে সীমাবদ্ধ করলে চলবেনা, বরং বৈশ্বিক ইসলামি পরিসরের যে দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তার সাথে যুক্ত করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায়, ইসলামি ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে রিচার্ড বুলিয়েট ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে তুলনা টেনেছেন সেটা বেশ সঙ্গতিপূর্ণ, এবং তা একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত সত্যকেই নির্দেশ করে। তার প্রস্তাবনার সারাংশ হল- জাতিরাষ্ট্রকে যে ইতিহাসতত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়, উপমহাদেশের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে একইভাবে বিচার করা যথার্থ নয়।
জাতিবাদী ইতিহাস তত্ত্বের আলোকে উপমহাদেশকে বিশ্লেষণের সমস্যা অনুধাবনে তুরষ্কের কামালবাদী (Kemalism) প্রকল্পকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। কামালবাদী প্রকল্প হল, উসমানী সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপরে মোস্তফা কামাল কর্তৃক প্রণীত চেতনা, কর্মপন্থা কিংবা বাস্তব পদক্ষেপের সমষ্টি। জাতিবাদী ইতিহাসতত্ত্বের আলোকে দেখলে দেখা যায় যে, এর সম্পর্ক কেবল তুর্কি প্রজাতন্ত্র বা তুর্কি জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের সাথে। কিন্তু A Fundamental Fear (সাইয়িদ ২০১৫) বইয়ে কামালবাদকে এ ধরনের সংকীর্ণ জাতিবাদী গন্ডির বাইরে এসে দেখবার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কামালবাদ ধারণাকে মোটাদাগে বিংশ শতাব্দীর বিউপনিবেশিকরণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কল্পনা করা যায় এবং এভাবে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম সমাজে উদ্ভূত একই রকম প্রচেষ্টার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কামালবাদি প্রকল্প তাই কোন বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা নয়, যা কেবল তুরষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত; বরং এটি উসমানী পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে বৃহৎ পরিসরে আরো অনেক সমজাতীয় অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা রাখে। ফলে ইরানের রেজা পাহলভী ( ১৮৭৮-১৯৪৪), আফগানিস্তানের আমানুল্লাহ খান (১৮৯০-১৯৬২), ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন এবং মিশরের নাসের (১৯১৮-১৯৭০)— এ সকল বিচিত্র ব্যক্তিবর্গের চিন্তা ও কর্ম পদ্ধতিকে কামালবাদের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা সম্ভব। কিন্তু একে পাকিস্তানের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে আমরা দেখব যে, পাকিস্তানের পরিগঠন কামালবাদী চিন্তা-চেতনার প্রতি এক রকম চ্যালেঞ্জ। কেননা আধুনিকতা নিয়ে কামালবাদের ভাবনা হল, ইসলামি-ভাবাপন্ন সমাজকে পাশ্চাত্যকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া; সেক্ষেত্রে ইসলাম হল তার নিকট প্রাচ্য-দেশীয় চিন্তা-চেতনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কামালিজম মনে করে, ইসলাম-প্রভাবিত সমাজে মুসলিম পরিচয় নয়, বরং জাতিবাদী পরিচয়ই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তাসত্তার (political subjectivity) বাহন হতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলন কোন নৃতাত্ত্বিক বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে হয়নি; বরং এর ভিত্তি ছিল একটি রাজনৈতিক মুসলিম কর্তাসত্তা (politicised Muslim subjectivity)। তাই ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানরা যখন নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করে, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে- মুসলমানিত্বের প্রশ্নটিকে এখন আর কেবল ব্যক্তিগত পরিসরের বিষয় হিসেবে খারিজ করে দেয়া সম্ভব নয়। বরং মুসলিম গণজাগরণ যে স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি তুলে ধরেছিল, তার মধ্যে আমরা দেখতে পাই— মুসলিম আত্মপরিচয়ের আবির্ভাব এবং একটি ইসলামি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ। আর এ দাবির বাস্তবায়ন কেবল পাকিস্তান ধারণার মধ্য দিয়েই সম্ভব ছিল।
মূলতঃ একটি মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের আকুতির মধ্যে দিয়ে একই সাথে ভারতবাদ (Indology) স্বীকৃতি দেয়া এবং প্রত্যাখান করা হয়। স্বীকৃতি এই অর্থে যে, ভারত যে মূলত হিন্দু পরিচয়ভিত্তিক—এটা আপাতত মেনে নেয়া; কিন্ত আবার প্রত্যাখ্যানও এ কারণে যে, এটা ‘হিন্দু’ ইন্ডিয়ায় একটি মুসলিম বাসভূমি তৈরি করবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। সুতরাং পাকিস্তান আন্দোলন কামালবাদী চিন্তার বিপরীতে একটি প্রতি-উত্তর। কারণ কামালবাদ যে মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করে, পাকিস্তান আন্দোলন তারই পূণর্জাগরণ ঘটায়। মূলতঃ দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে ইসলাম-প্রভাবিত একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, যা ভবিষ্যত প্রকল্প আকারে নিজেকে হাজির করতে সক্ষম ছিল।
বৃটিশ শাসিত দক্ষিণ-এশিয়ার প্রেক্ষিতে তিন ধরণের সম্ভাব্য কর্তাসত্তার (subject position) কথা কল্পনা করা যায়, যার উপর ভিত্তি করে বিউপনিবেশিকরণ প্রকল্পকে দাঁড় করানো যেতে পারে। প্রথম সম্ভাব্য সত্তা হল- সর্বভারতীয় আত্মপরিচয়। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতাকে সংহতি ও গণজাগরণের বুনিয়াদি উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা। একজন সর্বভারতীয় কর্তাসত্তা নিজেকে সংগঠিত করবে কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি, ভাষাগত কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধীনে নয়; বরং বৃটিশ কিংবা ইউরোপিয় কর্তাসত্তারই অংশবিশেষ হিসেবে। দ্বিতীয় সম্ভাব্য সত্তা হল- বহুজাতি বিশিষ্ট দক্ষিণ এশীয় কর্তাসত্তা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়া নিছকই একটি ভৌগলিক অভিব্যক্তি; বরং এর অধীনে বিভিন্ন অঞ্চল যেমন গুজরাট, পাঞ্জাব, বাংলা প্রত্যেকেই আলাদা সাহিত্য, ভাষা এবং যৌথ এলাকা এবং সাধারণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিজ নিজ জাতিরাষ্ট্র তৈরি করবে। তৃতীয় পরিস্থিতি হতে পারে, কিছু আদর্শিক নীতির ভিত্তিতে তৈরি কর্তাসত্তা— যা বহু অঞ্চল ও নৃগোষ্ঠিকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে। এটি কেবল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কিংবা ইউরোপিয় পরিচয়কেই রোধ করবে না; বরং একাট্টা ভারতীয় পরিচয়—যা মূখ্যত হিন্দু পরিচয়কে নির্দেশ করে—সেটাকেও প্রতিহত করবে। আর এই তৃতীয় সম্ভাব্য কাঠামোর উদাহরণই হল পাকিস্তান ধারণার আবির্ভাব (সাইয়িদ, ২০১৪: ২৮১- ২৮২)।
মওদুদী পাকিস্তানকে একটি ‘মতাদার্শিক রাষ্ট্র’ হিসেবে তত্ত্বায়ন করেছিলেন। আর এর মাধ্যমে এ চিন্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যে, নতুন এই রাষ্ট্রটির কোন নজির অতীতের ইসলামোনুপ্রাণিত রাষ্ট্র সমূহের মাঝে পাওয়া যায়না। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বৈপ্লবিকতা কেবল সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র তৈরির সফলতার মধ্যেই নিহিত না; বরং কোন ঐতিহাসিক নজির ছাড়াই প্রায় শূণ্য থেকে এর অস্তিত্বশীল হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি তাৎপর্যপূর্ণ। মতাদর্শিক রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈধতা অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের মত অতীতে নয়, বরং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মধ্যে সন্ধান করা হয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান পরিগঠনের ক্ষেত্রে মতাদর্শ তাই এখানে অতীত ঐতিহ্যের বিকল্প। তবে মতাদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের তত্ত্বায়ন অপরিপক্কই থেকে গিয়েছে। আর এই অপরিপক্কতার কারণ মূলত এই নয় যে, পাকিস্তানের মানে কি এ ব্যাপারে মতৈক্য না হওয়া, কিংবা নতুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিবাদমান নানা বিষয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন থাকা। এ সমস্ত ব্যর্থতা কেবলই উপসর্গ, সমস্যার মূল কারণ নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে বিবাদমান প্রকৃতি তার উদ্ভব ঘটেছে এটাকে সঠিকভাবে চিত্রিত করবার ব্যর্থতা থেকে নয়; বরং পাকিস্তানকে যথাযথভাবে বিউপনিবেশিকরণ এর ব্যর্থতা থেকে।
এই অসম্পূর্ণ বিউপনিবেশিকরণেরই একটি উপসর্গ হল, পাকিস্তানের এলিটদের পক্ষে এ রাষ্ট্রের মর্ম অনুধাবনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। পাকিস্তানের পরিগঠন হতে পারত কামালিজম এর জন্য প্রথম কোন বড় অপনোদন। কারণ পাকিস্তান নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভাষাভিত্তিক কর্তাসত্তার গণজাগরণ এর উপর ভিত্তিশীল ছিলনা, বরং এর ভিত্তি ছিল মুসলমানিত্বের উপর; অথচ কামালবাদ তার বয়ান শুরু করে মুসলিম আত্মপরিচয়ের এই রাজনীতিকরণকে খারিজ করার মধ্য দিয়েই। সুতরাং পাকিস্তানে আমরা একটি মুসলিম গণজাগরণের আবির্ভাব দেখি এবং একই সাথে দেখি সুস্পষ্টভাবে একটি ইসলামি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের পক্ষে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে। অর্থাৎ ইসলামিক আদর্শচিন্তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি হবে— এমন ভাবনাটা এখানে মূখ্য। অন্য ভাষায়, ইসলাম এমন ধর্মীয় আচার-আচারণের সমষ্টি নয় যাকে কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়; বরং এটা এমন সব বিশ্বাসের সমষ্টি যার আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। সুতরাং একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে (নতুন করে) ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে। যদিও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনা সম্ভব হয়েছিল এভাবে কামালবাদকে খারিজ করে দেয়ার মাধ্যমে, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের কার্যপ্রক্রিয়ায় এই খারিজ করে দেয়ার ব্যাপারটি প্রতিফলিত হয়নি। বরং পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই আদি পরিকল্পের জায়গায় কামালবাদী রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিসমূহ ক্রমে স্থান করে নিতে থাকে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে বিতর্কের মধ্য দিয়ে এটা ভালভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক ধরণের কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। যেমন, প্রকৃত অর্থেই একটি বহুভাষাভাষি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেয়া, কিংবা রাষ্ট্রীয় ভাষা গ্রহণের ব্যাপারটাকেই খারিজ করা, অথবা এমন একটি ভাষাকে (আরবী কিংবা ফারসি) গ্রহণ করা যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতে বিদ্যমান সকল ভাষাভিত্তিক ক্রমবিন্যাসকে প্রতিস্থাপন করে। কিন্তু এ সকল বিকল্পের বদলে উর্দু এবং ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়; যা অন্যান্য ভাষার প্রশ্নে, যেমন বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। একইরকম আরো অনেক পরিবর্তন ঘটে; যেমন, পাকিস্তানের নাগরিক আইন মুসলিম অধিকারের প্রশ্নকে কেবল পাকিস্তানিদের জন্য সীমাবদ্ধ করে, যা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য মুসলমানদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করেনি।
অন্যভাবে বললে, পাকিস্তান ক্রমেই একটি প্রচলিত রাষ্ট্রের আকার ধারণ করে যেখানে কামালবাদী বিধি-বিধান এবং ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতাই পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। একদা ইসলামের নামে তৈরি হওয়া যে গণজাগরণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল, নতুন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এর পরিগঠনের সেই বৈপ্লবিক প্রকৃতিকে বরং অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। আর এভাবেই ইসলাম প্রশ্নের বিরাজনীতিকরণ শুরু হয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য কামালবাদী রাষ্ট্র প্রকল্প যেখানে তার বুনিয়াদি চেতনার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিশীল, সেখানে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এসে আমরা দেখতে পাই একটি ভিন্ন চিত্র। পাকিস্তানের আদি বুনিয়াদি পরিকল্প হল, এটিকে মুসলমানদের আবাসভুমি হিসেবে প্রস্তুত করা। কিন্তু পাকিস্তানী কামালবাদী প্রবণতা পাকিস্তানকে পরিচালিত করতে থাকে ঠিক তার উল্টো দিকে। আর এভাবেই পাকিস্তান তার আদি প্রকল্প থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়ে। আর এর ফলাফল হল, পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বিউপনিবেশিকরণ প্রকল্পের যে নিরীক্ষা হওয়ার আশা ছিল— তা অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শোকাবহ ঘটনা হল, যারা এটাকে শাসন করেছে তারা এর আদি রূপকল্পে বিশ্বাস করেনা; আর যারা এতে বিশ্বাস করে তারা আজও পর্যন্ত এটাকে শাসন করবার সুযোগ পায়নি।
তথ্যসূত্রঃ
Arjomand, A (2007)., “Islamic Constitutionalism” Annual Review of Law and Social Science, vol 3, pp. 115-140.
Bulliet, Richard W. ‘Iran Today’ http://agenceglobal.com/2016/12/12/iran-today/ Accessed 30 June 2017.
Sayyid, S. 2015. A Fundamental Fear. 3rd edn. London: Zed Books.
Sayyid, S, (2014) Recalling the Caliphate, Oxford: Oxford University Press.
“Khomeini and the Decolonization of the Political.” Critical Introduction to Khomeini, edited by Arshin Adib-Moghaddam, Cambridge: Cambridge University Press
Talbot, Ian (1998) Pakistan: A Modern History, London: Hurst Publishers
সূত্রঃ The Meaning of Pakistan