যে ফিকাহ প্রয়োজন আমাদের কোন কোন ধরনের ফিকাহ প্রয়োজন, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন রিজেকশন এন্ড এক্সট্রিমিজম’ বইয়ে আলোচিত হয়েছে। তাতে আমলের ফিকাহ এবং কর্মের ক্রমবিন্যাসের ফিকাহ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে।
বক্তব্যের আরেকটি অংশ আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন পারমিটেড ডিফারেন্সেস এন্ড ব্লেমওয়ার্দি ডিজইউনিটি’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে আমাদের অন্যতম প্রধান প্রয়োজনীয় ‘মতানৈক্যের ফিকাহ’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের পাঁচ ধরনের ফিকাহ দরকার। এখানে এরমধ্যে মাত্র দু’টি ফিকাহর ওপর আলোচনা করা হয়েছেঃ
১) ভারসাম্যের ফিকাহ (ফিকহ উল মুয়াজানাত)
২) অগ্রাধিকারের ফিকাহ (ফিকহ উল আওলাইয়াত) এ ধরনের ফিকাহর প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
ভারসাম্যের ফিকাহ
ভারসাম্যের ফিকাহ বলতে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝিঃ
১. আকার ও সামর্থ্য, মূল্য ও ফলাফল এবং সহনক্ষমতার আলোকে কোনটির চেয়ে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে ভারসাম্য রক্ষা করা যাতে কোনটির উপর অগ্রধিকার দেয়া যায় এবং কোনটি স্থগিত রাখা যায় তা নির্ণয় করা যায়।
২. ভালো বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মতো মন্দ বিষয়গুলোর মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষা করা, যেন কোনটি গ্রহণ এবং কোনটি পরিহার করতে হবে তা নির্ধারণ করা যায়।
৩. ভালো ও মন্দ বিষয়গুলো যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে ভালো লাভের চাইতে মন্দ বিষয় পরিহারের উপর অগ্রাধিকার দেয়া এবং ভালো লাভের স্বার্থে কোন কোন ক্ষেত্রে মন্দকে কখন উপেক্ষা করা যায় তা স্থির করা।
দু’ধরনের ফিকাহ এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজন দু’পর্যায়ের ফিকাহঃ
শরীয়াহর ফিকাহ
প্রথম হচ্ছে শরীয়াহর ফিকাহ। শরীয়াহর প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে অনুধাবনই হবে এর ভিত্তি। এর লক্ষ্য হচ্ছে উপরোক্ত ‘ভারসাম্য নীতিমালার’ অকাট্যতা প্রতিপন্ন করে এর প্রামাণিকতা নির্ণয় করা। এটি তাদের কাছে স্পষ্ট হতে হবে যারা শরীয়াহর মূল উৎস ও হুকুম-আহকাম অনুধাবন এবং এগুলোর গূঢ় তত্ত্ব উদঘাটনে সচেষ্ট।
শরীয়াহ কেবল মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণে কয়েক ধরনের সহজাত চাহিদাকে সামনে রেখেই পাঠানো হয়েছে। এর কল্যাণকর পর্যায়গুলো হচ্ছেঃ অপরিহার্য (আল দুরুরিয়াহ), প্রয়োজনীয় (আল হাজিয়াহ) ও সৌন্দর্যবোধক (আল তাহসিনিয়াহ)।
বাস্তবতার ফিকাহ
দ্বিতীয় পর্যায়ের এ ফিকাহ আসলে ইতিবাচক যার ভিত্তি হচ্ছে সমকালীন বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা। অত্যন্ত সঠিক তথ্য উপাত্ত নির্ভর গবেষণা সতর্কতার সঙ্গে ব্যাপক ক্ষেত্রে চালাতে হবে। এ ব্যাপারে প্রচারমূলক উপাত্ত ও প্রশ্নমালা ভিত্তিক বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব তথ্য পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এসবের পেছনে, একটি মতলব কাজ করে। এতে সামগ্রিকভাবে সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্য থাকে না।
ফিকাহর সমন্বয়
শরীয়াহর ফিকাহ ও বাস্তবতার ফিকাহ উভয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। যাতে করে আমরা যথাযথ তাত্ত্বিক ভারসাম্যকরণ প্রক্রিয়ায় পৌঁছতে পারি, যা একই সাথে উগ্রতা ও ঔদাসীন্য মুক্ত হবে। নীতিগতভাবে এখানে শরীয়াহর ফিকাহ’র বিষয়টি স্পষ্ট। এ বিষয়ে উসূল আল-ফিকাহ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘আল-মুসতাসফা’ (ইমাম গাজ্জালী) থেকে শুরু করে ‘আল-মুয়াফাকাত’ (ইমাম আল-শাতিবি) পর্যন্ত এবং নিয়মবিধি, সাদৃশ্য ও ভিন্নতা সংক্রান্ত বই-পু্স্তকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
যখন নানামুখী স্বার্থের সংঘাত হয়, তখন উচ্চতর স্বার্থে নিম্নতর স্বার্থ এবং সাধারণের স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থের মালিককে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া উচিত। পরস্পর বিরোধী স্বার্থের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদীর স্থলে দীর্ঘ মেয়াদী অথবা স্থায়ী স্বার্থ, তুচ্ছ স্বার্থের স্থলে প্রকৃত স্বার্থ এবং অনিশ্চিত স্বার্থের পরিবর্তে সুনিশ্চিত স্বার্থের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া আবশ্যক।
আমরা দেখেছি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত, মৌলিক ও ভবিষ্যত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যা অন্য কেউ হলে কখনোই ছাড় দিতে চাইতো না। তিনি এমন শর্ত মেনে নিয়েছিলেন যা প্রথম নজরেই মুসলমানদের জন্যে অন্যায্য ও অবমাননাকর মনে হয়েছিল। তিনি ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নামে’ বাক্যটি তুলে ফেলতে সম্মত হয়েছিলেন। সে স্থলে লেখা হয়েছিল ‘হে প্রভু আপনার নামে’। তিনি চুক্তিতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি উল্লেখ না করে কেবল তার নাম ‘মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ’ লিখতেও রাজী হন। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে।
ক্ষতিকর বিষয়গুলো পরস্পর বিরোধী হলে এবং এগুলোর মধ্যে কোনোটি যদি অপরিহার্য হয় তবে দু’টি মন্দের কম মন্দটি এবং অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর মন্দ বিষয়টি বেছে নেয়া উচিত। মুসলিম মনীষীরা ক্ষতিকর বিষয় যথাসম্ভব নির্মূল করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কোনো বড় ধরনের ক্ষতিকর বিষয়ের স্থলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর বিষয় নির্মূল করা উচিত নয়। একটি ছোট ক্ষতি সহ্য করা উচিত যদি তাতে একটি বড় ক্ষতি পরিহার করা সম্ভব হয়। আবার সাধারণের ক্ষতি এড়ানোর স্বার্থে ব্যক্তির ক্ষতি স্বীকার করে নেয়া উচিত। এর বহু উদাহরণ ‘আল কাওয়ায়িদুল ফিখিয়া’ ও ‘আল আসবাহ্ ওয়ান নাজায়ের’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি লাভ ও ক্ষতির সংঘাত দেখা দেয় তবে আকার, ফলাফল ও মেয়াদের নিরিখে তার বিচার করতে হবে। একটি বৃহত্তর স্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে সামান্য ক্ষতি উপেক্ষা করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী অথবা স্থায়ী স্বার্থের জন্যে কোনো সাময়িক ক্ষতি মেনে নেয়া উচিত। এমন কি কোনো বড় ক্ষতিকেও মেনে নেয়া যায় যদি এর চেয়েও বড় ক্ষতি নির্মূলের সম্ভাবনা থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় স্বার্থ আদায়ের আগেই ক্ষতিকর বিষয় এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত।
এ ভাবধারা কেবল তত্ত্ব হিসেবে মনে করা উচিত নয়, বরং এগুলো আমাদেরকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। কারণ, সক্রিয় ইসলামী গ্রুপগুলোর মধ্যে এসব ভারসাম্যকে ঘিরেই নানা মতপার্থক্য বিদ্যমান।
বৈরী শক্তির সাথে জোট বাধা যেসব সরকার ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত নয় তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা সন্ধি স্থাপন কি মেনে নেয়া যায়?
যে ক্ষমতাসীন সরকার বিশুদ্ধ ইসলামী চরিত্রের সরকার নয়, ক্রটিপূর্ণ সংবিধান দ্বারা পরিচালিত অথবা যার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন নেই- সেই সরকারে অংশগ্রহণ করা কি উচিত?
একটি ধর্মবিরাধী, স্বেরাচারী ও অত্যাচারী অসৎ সরকারকে হটানোর জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত বিরোধী ফ্রন্টে আমাদের যোগদান করা কি উচিত?
সুদভিত্তিক মানব রচিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবাধীন পরিবেশে আমরা কি ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারি?
সাধারণভাবে মুসলমানদেরকে সুদভিত্তিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে দেয়া অথবা ইসলামের শিক্ষা অনুসরণকারী দ্বীনদার লোকদেরকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করা থেকে বিরত রাখা কি উচিত?
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
নীতিমালা প্রণয়ন করা সহজ, কিন্তু এগুলো মেনে চলা কঠিন। সাধারণ মানুষ এবং যারা সামান্য কারণে শোরগোল করেন তাদের পক্ষে ভারসাম্যের ফিকাহ অনুধাবন করা সহজ নয়।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী এবং তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের স্থলে ফাতেমা জিন্নাহকে নির্বাচনে সমর্থন করা ভারসাম্যের ফিকাহর আলোকে কম ক্ষতিকর বলে মত প্রদান করায় তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তীব্র প্রতিরোধ ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিলেন। একটি জাতি কোনো মহিলাকে তাদের নেতা নিযুক্ত করলে কখনোই উন্নতি করতে পারবে না-এ হাদিসকে ভিত্তি করে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রচারণা চালানো হয়। তাহলে সেই জাতির কী হবে যারা কোনো স্বৈরশাসককে তাদের নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়? তারা কী কাজটা খুব ভালো করবে? কখনোই না। এখানেই ভারসাম্যের ফিকাহর কাজ হচ্ছে দু’টি অনিষ্টের মধ্যে কম অনিষ্টকে বেছে নিয়ে বৃহত্তর ক্ষতি পরিহার করা।
সুদানের ইসলামী আন্দোলনের নেতা ড. হাসান আল তুরাবী এবং তার সহযোগীবৃন্দ সোস্যালিস্ট ইউনিয়নে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেয়ায়, এমন কি সুদানে ইসলামী শরীয়াহ চালু করার ঘোষণা দেয়ার আগেই তারা জাফর নুমায়ের সরকারের পদ গ্রহণ করায় কোনো কোনো ইসলামপন্থী তাদের কঠোর সমালোচনা করে।
সিরিয়ায় আমাদের সহযোগী ভ্রাতৃবৃন্দ তাদের সমূলে ধ্বংসে উদ্যত স্বৈরশাসনের প্রতিরোধে কোনো কোনো অনৈসলামী শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে একই রকম বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অথচ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) স্বয়ং বহু ঈশ্বরবাদী খুজয়াহ গোত্রের সঙ্গে মিত্রতা করেছিলেন এবং কখনো কখনো বহু ঈশ্বরবাদী এক গ্রুপের বিরুদ্ধে অপর এক গ্রুপকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
অবশ্য আমি এখানে কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। আমি কেবল একটি নীতি তুলে ধরছি, সেটি হচ্ছে ভারসাম্যের ফিকাহ- যার ওপরে ‘শরীয়াহ রাজনীতির’ কাঠামো র্নিমাণ করা উচিত। অনৈসলামী শাসনে অংশগ্রহণ অথবা অমুসলিম শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা অনুমোদনযোগ্য- এ বক্তব্যের সমর্থনে রাসূলুল্লাহ (সা:) ও তাঁর সাহাবিদের গৃহীত অবস্থান এবং আমাদের সুবিস্তৃত শরীয়াহর বিধানে বহু দলিল রয়েছে।
ভারসাম্যের ফিকাহ’র প্রমাণ
আমরা যদি আল-কোরআনের মক্কী ও মাদানী সূরাগুলো সতর্কতার সঙ্গে অধ্যয়ন করি তাহলে ভারসাম্যের ফিকাহর অনেক প্রমাণ এবং একটি বিষয়ের সাথে আরেকটির গুরুত্ব পরিমাপের উপায় দেখতে পাব।
আমরা ভারসাম্যের স্বাথের উদাহরণ দেখতে পাই হযরত মূসা (আ.) এর প্রশ্নে হযরত হারুনের (আ.) জবাবে বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যেঃ হে আমার মাতৃতনয়। তুমি আমার দাড়ি ধরো না, মাথাও স্পর্শ করো না, আমি এ আশঙ্কা করেছিলাম যে তুমি বলবে, তুমি বনি ইসরাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ, আর তুমি আমার কথার সম্মান দাওনি। (সূরা ত্বাহাঃ ৯৪)
আবার অনিষ্টকর বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্যের নজির দেখা যায় খিজির (আ.) কর্তৃক নৌকা ফুটো করে দেয়ার ব্যাখ্যার মধ্যেঃ আর নৌকাটির ব্যাপার হচ্ছে, বস্তুত তা ছিল কতিপয় গরীব লোকের যা দিয়ে তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত, সুতরাং তাতে ফুটো সৃষ্টি করতে চাইলাম এবং তাদের অপর দিকে ছিল এবং বাদশাহ যে প্রত্যেকটি নিখৃঁত নৌকা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিত। (সূরা আল কাহ্ফঃ ৯৪)
নৌকাটি পুরোপুরি হারানোর চেয়ে ফুটো নৌকাটি রাখাই মালিকের জন্যে কম ক্ষতিকর। অর্থাৎ সব কিছু হারানোর পরিবর্তে নিঃসন্দেহে কিছুটা বাঁচিয়ে নেয়া অনেক ভালো।
আল্লাহর কালামেও ভারসাম্যের ফিকাহর বিষয়টি স্পষ্ট রয়েছেঃ
মানুষ আপনাকে সম্মানিত মাসে যুদ্ধ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, এ সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধ করা আল্লাহ তায়ালার কাছে গুরুতর অপরাধ। আর মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাঁধার সৃষ্টি করা এবং আল্লাহর সাথে কুফরি করা, মসজিদে হারামের পথে বাধা দেয়া এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করা আল্লাহর নিকট তার চেয়ে গুরুতর অপরাধ। আর ফেতনা সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষা অধিক জঘন্য। (সূরা আল বাকারাঃ ২১৭)
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বলছেন, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা গুরুতর অপরাধ, কিন্তু এর চেয়েও কোনো মারাত্মক অপরাধের প্রতিরোধে যুদ্ধ করা যেতে পারে।
মূর্ত ও বিমূর্ত স্বাথের মধ্যে তুলনার লক্ষ্যে আসুন আমরা পড়ি সেই আয়াত যেখানে আল্লাহ তায়ালা বদরের যুদ্ধের পর মুসলমানদের ভৎসনা করেছেনঃ নবীর পক্ষে শোভনীয় নয় যে তাঁর কাছে যুদ্ধবন্দী রয়েছে এবং তা তিনি মুক্তিপনের বিনিময়ে মুক্তি দেন অথচ তিনি ভূমিতে কাফেরদের প্রচুর রক্তপাত ঘটাননি; তোমরা তো দুনিয়ার ধনসম্পদ চাইছো, কিন্তু আল্লাহ চাইছেন আখেরাত; আর আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সুরা আল আনফালঃ৬৭)
ভালো ও মন্দের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে আসুন আমরা দেখি মহান আল্লাহ কি বলছেনঃ তারা আপনাকে মদ ও জুয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, উভয়ের ব্যবহারের মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু কল্যাণও আছে। আর এ দুটোর মধ্যে কল্যাণ অপেক্ষা পাপই অধিক গুরুতর। (সূরা আল বাকারাঃ২১৯)
বিভিন্ন অমুসলিম গ্রুপ ও চক্র একে অপরের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে সূরা আল রুমের প্রারম্ভিক কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পারসিকদের উপর রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এ সূরায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঐ দিন ঈমানদাররা আনন্দিত হবে। যদিও উভয় পক্ষই অমুসলিম। তবুও অগ্নিপূজক পারসিকদের তুলনায় রোমানরা মুসরমানদের ঘনিষ্ঠ। তারা আহলে কিতাব বলে মুসলমানদের অধিক কাছাকাছি।
ইবনে তাইমিয়ার মত শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্রে কোনো মুসলমানের সরকারী পদ গ্রহণ অনুমোদনযোগ্য বলে দৃঢ় মত প্রকাশ করেছেন, যদি সংশ্লিষ্ট পদাধিকারী ব্যক্তি কিছু কিছু অন্যায় অবিচারের প্রতিকার অথবা অসৎ কাজ ও দুর্নীতি দমনে ইচ্ছুক হন। (পরিশিষ্ট-১)
তিনি ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব অথবা দু’টোই যদি একসাথে সামনে আসে এ দু’য়ের সমন্বয় এবং আলাদা করা সম্ভব না হলে সাময়িকভাবে গ্রহণ অথবা বর্জনের ওপরে একটি বিস্তারিত অনুচ্ছেদও রচনা করেছেন। (পরিশিষ্ট-২)
ইসলামী অর্থনীতির ওপরে আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে১ অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন ফিকাহবিদ ও অর্থনীতিবিদ মত প্রকাশ করেন, মুসলিম দেশগুলোতে অনুমোদিত খাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠনের শেয়ার বেচাকেনা করা শরীয়াহর দৃষ্টিতে জায়েজ। যদিও এরূপ লেনদেনে সুদ-সংশ্লিষ্টতার কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকে। ভারসাম্যের ফিকাহর আলোকে এ ইস্যু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিম্পোজিয়ামে মত প্রকাশ করা হয়, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর খাত অমুসলিম অথবা অধার্মিক মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। কেননা এ পদক্ষেপ বিশেষত কোনো কোনো দেশে মারাত্মক বিপদ সৃষ্টি করবে। বরং শেয়ার হোল্ডারগণ সুদ-সংশ্লিষ্ট লেনদেন থেকে যে লভ্যাংশ পান বলে মনে করেন আনুপাতিকভাবে সেই অংশটি সাদাকাহ বা জনহিতকর কর্ম হিসেবে দান করে দিতে পারেন।
এ ফিকাহ অনুসারে বিবেকবান মুসলিম তরুণদেরকে ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্সের মতো কোম্পানিগুলো থেকে চাকরি না ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে অবশ্যই কিছু গুনাহর আশঙ্কা থাকলেও তারা সেখান থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তা ইসলামী অর্থনীতির বিকাশে কাজে লাগাতে পারেন। এভাবে তারা মনে মনে ক্ষতির দিকটা প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি গোটা পদ্ধতি ইসলামীকরণের প্রচেষ্টায় যারা নিয়োজিত তাদের সঙ্গেও অংশ নিচ্ছেন।
ভারসাম্যের ফিকাহর অনুপস্থিতি আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ প্রয়োগ না করি তাহলে আমরা বহু কল্যাণ ও লাভের দরজা নিজেরাই বন্ধ করে দেব। পরিণামে সব ব্যাপারে প্রত্যাখ্যানের দর্শনই একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে, ঝামেলা এড়ানোর অজুহাতে একঘরে হয়ে যাব এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে তার নিজের যুক্তি মোতাবেক সংঘর্ষে না জড়ানোর পথ বেছে নেব। তখন ইজতেহাদ সাপেক্ষ প্রত্যেক ব্যাপারে আমাদের পক্ষে ‘না’ বলা অথবা ‘এটি হারাম’ বলা সহজ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ প্রয়োগ করি তাহলে এক পরিস্থিতির সাথে আরেক পরিস্থিতির তুলনা, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এবং ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে ক্ষতির স্থলে লাভের পরিমাপ করার উপায় খুঁজে পাব। আর এভাবে আমরা সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ পরিহারের পথ বেছে নিতে পারব।
১৯৮০ সালে কাতার থেকে প্রকাশিত ‘দোহা’ ম্যাগাজিনে লেখার অনুরোধ পেয়েছিলাম। এটি একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা এবং এর অধিকাংশ সম্পাদকীয় কর্মী সেক্যুলারপন্থী। এর মূলনীতি ইসলাম বিরোধী না হলেও ইসলামপন্থী বা ইসলামের সমর্থকও নয়। আমি অনেক দিন ধরে ইতস্তত করার পর ভারসাম্যের নীতিতে প্রস্তাবটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেই পত্রিকাটি বয়কট না করে এতে লেখা দেয়াই বেশি ভালো হবে। কারণ এর পাঠকরা এক ব্যাপকভিত্তিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন যারা সাধারণত ইসলামী পত্র পত্রিকা পড়েন না। ‘আল উম্মাহ্’র মতো সাময়িকীর যে ধরনের পাঠক রয়েছে এ পত্রিকার পাঠকরা সেই শ্রেণীর নন বিধায় আমরা যখন সুযোগ পাচ্ছি তখন তাদের কাছে আমাদের কথা পৌঁছে দেয়া দরকার। আর এটি আল্লাহ প্রদত্ত আমাদের প্রতি দায়িত্ব।
এ কারণে এসব পত্র পত্রিকার নীতি আমাদের মতের অনুকূল না হলেও তাদেরকে সাক্ষাৎকার বা লেখা দিতে রাজী হওয়া উচিত। যে সব দৈনিক পত্রিকা স্পষ্টভাবে ইসলামী ধারা অনুসরণ করে না সে সব পত্রিকায় লেখালেখি করলে অনেকে এখনো দোষারোপ করেন। অনেকে আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন পারমিটেড ডিফারেন্সেস এন্ড ব্লেমওয়ার্দি ডিজইউনিটি’ বইটি সউদী দৈনিক ‘শারক আল আওসাত’ এ ধারাবাহিকবাভে প্রকাশের জন্যেও আমাকে দোষারোপ করেছেন। কারণ তারা এ পত্রিকার কোনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন না। কিন্তু আমি বহুল পঠিত এ পত্রিকায় বইটি ছাপানোর সুফলের দিকই বেশি বিবেচনা করেছি।
এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন, বিপথগামী চিন্তা চেতনার কারণে অডিও-ভিডিওসহ সকল গণসংযোগ মাধ্যম বর্জন করা উচিত। তারা ভুলে যান গণসংযোগ মাধ্যম বর্জন করা মানে এগুলো আরো জঘন্য রূপ নেবে এবং সেক্যুলার ও নোংরা মানসিকতার লোক ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক কাজ চালানোর সুযোগ পাবে। আর আমরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব যার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ’র আলোকে বিষয়টি পরীক্ষা করি তাহলে দেখব এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে কাজ করা কেবল জায়েজ ও বাঞ্ছনীয় নয় বরং অত্যাবশ্যক। কারণ এটি আমাদের দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং অশুভ কর্মকাণ্ডের যথাসাধ্য মোকাবিলার ন্যায্য একটি হাতিয়ার হতে পারে।
১। আলজারিয়ায় ১৯৯০ সালের ২-৫ মার্চ ৬ষ্ঠ বারাকাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরো কয়েকজন ফকীহর সঙ্গে আংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। তারা হচ্ছেন, শায়খ আব্দুল হামিদ আল সায়েহ, শায়খ জুখতার আল সালামী, ড. আবদুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ, ড. সাইয়েদ দার্শ ও ড. তালাল বাফাকীহ।
সূত্রঃ নতুন সফর প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত “আধুনিক যুগ ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি” গ্রন্থ