ইসলামী আন্দোলনঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে

বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রই প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কারণ ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াত প্রসারের এটিই হচ্ছে ভিত্তি। বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটই প্রধান সমস্যা। অনেক লোকের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে যেমন পরিষ্কার ধারণার অভাব রয়েছে, তেমনি ইসলামের শিক্ষা ও এসব শিক্ষার পর্যায়ক্রমিক গুরুত্ব অর্থাৎ কোনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি সাধারণ গুরুত্বের এবং কোনটি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয় এসব ব্যাপারে জ্ঞানের গুরুতর অভাব রয়েছে।

আমরা বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সম্পর্কেও জ্ঞানের গুরুতর অভাব দেখা যায়। অন্যদের সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এমন হয় যে তাদেরকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেই নয় তো খাটো করে দেখি। অথচ অন্যেরা আমাদের সব ধরনের খবর রাখে এবং তারা আমাদের বিষয়ে গভীরভাবে অবহিত।

এমনকি নিজেদের সম্পর্কেও আমাদের অজ্ঞতা রয়েছে। আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলো পুঙ্খানুভাবে খতিয়ে দেখিনি। বরং প্রায়শই ক্ষুদ্র বিষয়কে বড় করে দেখি অথবা চায়ের কাপে ঝড় তুলি। আমাদের শক্তি সামর্থ অথবা দোষ ত্রুটি যে দিকেই দেখি না কেন, উভয়ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এ অজ্ঞতা কেবল সাধারণ মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের স্বার্থ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের উপর নির্ভর করে সেই অগ্রণী দল, যাদের মৌলিক কাজের ওপর ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠবে তার সঙ্গে সংশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উভয়ের এ অজ্ঞতা প্রকট।

নতুন ফিকাহ

বস্তুত আমাদের দরকার এক নতুন ফিকাহ যাতে করে আমরা আল্লাহ যাদেরকে সমঝদার লোক বলে বর্ণনা করেছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে পারি। এখানে ফিকাহ বলতে ইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত ফিকাহ বোঝানো হয়নি। অর্থাৎ সেই আইনশাস্ত্র যা অজু, পাক-পবিত্র, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, বিবাহ, তালাক, শিশু লালন-পালনের শর্তাবলীর মতো বিস্তারিত বিশেষ বিধিবিধান নির্ণয় করে। এসব বিধিবিধান যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, আমরা এখানে তা বোঝাতে চাই না। কোরআন ও হাদিসেও ফিকাহ শব্দটি এ প্রসঙ্গে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে আমরা সে অর্থেও বোঝাতে চাই না। যেহেতু, এটি এমন সব শব্দ ও ভাবের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ইমাম গাজ্জালীও তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘এহিয়া উলমুদ্দীন’-এর জ্ঞান অধ্যায়ে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আল-কোরআনের মক্কী সূরাগুলোতে শরীয়াহর আওতায় আদেশ নিষেধের বিস্তারিত বিধান এমন কি সকল ফরজ, হুদুদ (দণ্ডবিধি) ও বিচারের আইন প্রবর্তনের পূর্বেই মূল শব্দ ফিকাহর উল্লেখ দেখা যায়।

মক্কায় অবতীর্ণ সূরা আল-আন’আমের ৬৫ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেনঃ বলুন তিনি এতই শক্তিমান যে তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করতে আসমান এবং যমীন থেকে বিংবা তোমাদেরকে দলে উপদলে বিভক্ত করে দ্বিধায় ফেলতে। এবং তোমাদের এককে অপরের উপর আক্রমণের স্বাদ গ্রহণ করান; লক্ষ্য কর! আমরা কিরূপে প্রমাণসমূহকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করছি, যাতে তারা বুঝতে পারে।

একই সূরার ৯৪ নং আয়াতে আরো উল্লেখ রয়েছেঃ আর তিনি এমন যে, যিনি তোমাদেরকে এক সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন; থাকার জন্য দিয়েছেন একটি স্থান (পৃথিবীতে বা মাতৃগর্ভে) আর একটি হচ্ছে গচ্ছিত স্থান। নিশ্চয়ই আমরা প্রমাণসমূহের বিশদরূপে বর্ণনা করেছি ঐ সকল লোকের জন্যে যারা উপলব্ধি করে।

এ দু’টি আয়াতে ফিকাহ শব্দের অর্থ হলো আত্মা, অন্তর ও অভিজ্ঞতার আলোকে আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বিধান, তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর নির্ধারিত সঠিক পথ থেকে যারা সরে যায় তাদের জন্যে তাঁর শাস্তি গভীরভাবে উপলব্ধি করা।

মক্কী সূরা আল আ’রাফের ১৭৯ নং আয়াতে যে সব লোক জাহান্নামে যাবে বলে মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাদের সম্পর্কে বলছেনঃ তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। এরপর এদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ এ সকল লোক চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং এরা তার চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট। এসব লোক হচ্ছে গাফেল।

বিভিন্ন সূরায় কোরআনের প্রতি বহু ঈশ্বরবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেনঃ আর আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দিয়েছি, যাতে তারা কোরআনকে না বোঝে এবং তাদের কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছি। (আল আন’আমঃ ২৫, বানি ঈসরায়ীলঃ ৪৬, আল কাহফঃ ৫৭)

আল-কোরআনের বেশ কয়েকটি মাদানী সূরায় ফিকাহ শব্দটি বহু ঈশ্বরবাদী ও মুনাফিকদের বোধশক্তি না থাকার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা ‘আল-আনফালের’ ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সাঃ) ও ঈমানদারদের সম্বোধন করে বলছেনঃ তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকে, তবে তাঁরা দুইশ’র উপরে জয়লাভ করবে, আর তোমাদের মধ্যে যদি একশ ব্যক্তি থাকে, তবে এক হাজার অবিশ্বাসীর উপর জয়লাভ করবে, এ কারণে যে তারা এমন লোক যারা বোঝে না।

এখানে অবিশ্বাসীদের জ্ঞান না থাকার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বিধিবিধান এবং পালাক্রমে সকল লোককে কিভাবে তিনি বিভিন্ন রকম সৌভাগ্যের দিন প্রদান করেন সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

সূরা-তাওবার ৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ মুনাফিকদের নিন্দা করে বলেছেনঃ এরা অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের সাথে থাকতে তৃপ্তিবোধ করল এবং তাদের অন্তরের ওপর মোহর লাগানো হলো, যাতে তারা উপলব্ধি না করে।

এখানে উপলব্ধি অর্থ হচ্ছে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা এবং দ্বীন রক্ষার উপলব্ধির অর্থ হচ্ছে জীবন, ইজ্জত, সম্পত্তি ও সামগ্রিক অর্থে সমাজকে রক্ষার জন্যে সচেষ্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা। এসব কাজ যে কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ- তা যতোই জরুরী হোক তার চেয়েও অগ্রাধিকার পাবে।

একই সূরার ১২৭ নং আয়াতে সবশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা (যাদের বোধশক্তির অভাব রয়েছে) এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে বলছেনঃ আর যখন কোনো সূরা নাজিল করা হয়, তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে; (এবং বলে যে) তোমাদেরকে কি কেউ দেখে না? অতঃপর তারা সরে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরগুলোকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, কারণ তারা হচ্ছে নির্বোধ সমাজ মাত্র।

এসব নির্বোধ লোক ভুলে যায় যে কোনো মানুষ তাদেরকে দেখার আগেই আল্লাহ তাদেরকে দেখতে পান। আসলেই তারা তাদের ফিকাহ এবং বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সূরা আল হাশরের ১৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদেরকে লক্ষ্য করে মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেনঃ নিশ্চয় তাদের অন্তরে আল্লাহর অপেক্ষা তোমাদের ভয় অধিক; এটি এ কারণে যে তারা বুঝতে পারে না।

সূরা আল মুনাফিকুনের ৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেনঃ এটি এ কারণে যে তারা ঈমান এনেছে, অতঃপর কাফের হয়েছে। তাই তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে, অতএব তারা বুঝতে পারছে না।

একই সূরার ৭ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ তারাই বলে, আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে যারা রয়েছে তাদের জন্যে কিছুই ব্যয় করো না, যতক্ষণ না তারা তাকে পরিত্যাগ করে। অথচ আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদরাজি আল্লাহরই অধিকারে আছে, কিন্তু মুনাফিকরা বোঝে না।

এতে দেখা যায়, ‘সে সব লোক যারা বোঝে না’- এ মুনাফিকদের সম্পর্কেই কোরআনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, মুনাফিকদের ধারণা তারা বুদ্ধিমান। তাই তারা পক্ষাবলম্বন না করে সুবিধাবাদী অবস্থান নেয়, দ্বিমুখী নীতি নিয়ে আল্লাহ ও ঈমানদারদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। বিশ্বাসীদের সঙ্গে মিলিত হলে তারা বলে, আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন তাদের দুষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রিত হয় তখন তারা বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি।

কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ বহু আয়াতে তাদের রহস্য দ্বিধা এবং ধোঁকাবাজি প্রকাশ করে দিয়েছেন। সূরা আল-বাকারার ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে বলে মনে করে, বস্তুত তারা নিজেদের সাথেই ধোঁকাবাজি করে এবং তারা তা অনুধাবন করতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা ও মানুষের সামনে তাদের মুনাফিকী ধরা পড়েছে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে তারা হারিয়েছে এবং নিশ্চিতই তারা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে। এর চেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি আর কী হতে পারে?

সুতরাং এ বর্ণনা অনুযায়ী কারো মধ্যে মুনাফিকীর লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে, নিঃসন্দেহে বুঝতে হবে তার মধ্যে ন্যূনতম পরিমাণ বোধশক্তি নেই।

উপসংহার আল-কোরআনের বাচনভঙ্গি অনুযায়ী ফিকাহ শব্দটি আজকের ভাষায় আইনশাস্ত্রের পারিভাষিক অর্থ বোঝায় না। বরং আল্লাহর কালাম এবং সৃষ্টি জগত, জীবন ও সমাজ সম্পর্কিত তাঁর বিধিবিধান উপলব্ধি ও জ্ঞান আহরণ বোঝায়।

এমন কি সূরা তওবার ১২২ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ তাদের প্রত্যেক দলের মধ্যে হতে একটি করে অংশ যেন জিহাদে যায়। যাতে অবশিষ্ট লোক দ্বীনি জ্ঞান-গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং জিহাদে যোগদানকারীরা নিজ কওমে ফিরে এলে যাতে তারা অসৎ কাজ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে।

এ আয়াতের ফিকাহ শব্দটি প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আইনশাস্ত্র সম্পর্কিত এরূপ অর্থ করলে তাতে সেই হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হবে না যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থের হেরফের করা অথবা নিজেকে রক্ষা এবং দাওয়াতি কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতির ব্যাপারে সতর্ক করতে পারে।

আল-কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে ‘ফিকাহ’ শব্দের যে ব্যবহার এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর একটি হাদীসেও এর ব্যবহারের মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। হাদিসটি হচ্ছেঃ আল্লাহ যদি কোনো ব্যক্তির কল্যাণ করতে চান তবে তিনি তাকে দ্বীনি এলেমে পারদর্শী করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তার দৃষ্টিকে আলোকিত করবেন যাতে করে সে কেবল শব্দাবলি আর ভাসাভাসা অর্থ নিয়ে আত্মতৃপ্তির পরিবর্তে দ্বীনের সত্যতা, গূঢ়তত্ত্ব ও লক্ষ্য আরো ভালোভাবে অনুধাবনের জন্যে গভীর সাধনা চালাতে পারে।

সূত্রঃ নতুন সফর প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত “আধুনিক যুগ ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি” গ্রন্থ

 

৯৬৫

বার পঠিত

ইউসুফ আল ক্বারাদাওয়ী

প্রফেসর ড. ইউসুফ আল ক্বারাদাওয়ী একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, পন্ডিত ও কুশলী। ইসলামী জ্ঞানে তাঁর গভীরতা এবং সমসাময়িক বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের কি ভূমিকা হবে সে বিষয়ে সুচিন্তিত মতামতের জন্য তিনি সারা বিশ্বে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংলাপের উপর তিনি সব সময় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিখ্যাত মিশরীয় পণ্ডিত ড. ক্বারাদাওয়ীর জন্ম ১৯২৬ সালে। দশ বছর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ কুরআন হেফজ করেন এবং কুরআন তেলাওয়াতের নীতিমালা, তাজবীদের উপর ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তিনি আল আজহারেই পড়ালেখা করেন। ১৯৭৩ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উসূল আল দ্বীন অনুষদ হতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ড. ক্বারাদাওয়ী আল আজহার ইনস্টিটিউটে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনার সময়ই তার প্রতিভার স্বাক্ষর হিসেবে শিক্ষকদের কাছ থেকে আল্লামা বা মহান পণ্ডিত খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৫৮ সালে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের উপর ডিপ্লোমা করেন। এর আগে তিনি আরবী ভাষা অনুষদ থেকে শিক্ষকতার সনদ পান।

ড. ক্বারাদাওয়ী মিশর সরকারের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বোর্ড অব রিলিজিয়াস এফেয়ার্স-এর একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি আলজেরীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ইসলামিক সায়েন্টিফিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেদ্দাস্থ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ফিকাহ একাডেমী, মক্কাভিত্তিক রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ফিকাহ একাডেমী, রয়াল একাডেমী ফর ইসলামিক কালচার এন্ড রিসার্চ জর্ডান, ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার অক্সফোর্ড-এর সদস্য, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া এন্ড রিসার্চ-এর প্রেসিডেন্ট এবং কাতার সীরাহ স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক। তিনি বাংলাদেশস্থ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম এর ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য।

তাঁর এ পর্যন্ত ৪২টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি, তুর্কী, ফার্সী, উর্দু, ইন্দোনেশিয়া সহ বিশ্বের অন্যান্য অনেক ভাষায় তার বই অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত এ বইটি সহ মোট ৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘ইসলামে হালাল-হারামের বিধান’, ‘ইসলামের যাকাত বিধান’, ‘ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন’ বই তিনটি খায়রুন প্রকাশনী প্রকাশ করেছে। এছাড়া নতুন সফর প্রকাশনী, ঢাকা ‘আধুনিক যুগ, ইসলাম, কৌশল ও কর্মসূচি’ এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অন দ্যা কুরআন এন্ড সুন্নাহ, চট্টগ্রাম ‘দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম’ প্রকাশ করেছে। ড. ক্বারাদাওয়ীর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত www.qardawi.net/english বই ওয়েব সাইটে পাওয়া যায়।

তিনি একজন স্বনামধন্য কবি। নিজস্ব কাব্য বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি আরব বিশ্বে সুপরিচিত। বর্তমানে ড. ক্বারাদাওয়ী আল জাজিরাহ টেলিভিশনে একটি সরাসরি সম্প্রচারিত সাপ্তাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক শ্রোতা এ অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকেন।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ইসলামের একজন সক্রিয় কর্মী। এর জন্য তাঁকে ১৯৪৯, ১৯৫৪-১৯৫৬ এবং ১৯৬৫ সালে কারাবরণ করতে হয়। আরব ও মুসলিম দেশ সমূহের প্রতি পাশ্চাত্য বিশ্বের বিশেষ করে আমেরিকা ও বৃটেনের পররাষ্ট্র নীতির জন্য তিনি তাদের একজন কঠোর সমালোচক। একই সাথে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ইসরাঈলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ, একপেশে ও নিঃশর্ত সমর্থনের তিনি তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করেন। ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগণের মতামতকে শাণিত করতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। তিনি একজন মানবাধিকারের প্রবক্তা। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের সপক্ষে তিনি সোচ্চার যা তার বিভিন্ন লেখনীতে প্রতিফলিত হয়েছে।

ড. ক্বারাদাওয়ী পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, আরব ও মুসলিম দেশসমূহ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার এসেছেন।