সাহিত্যের উৎস হৃদয়, অন্য কিছু নয়

অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে, লেখা শেখা যায় কীভাবে? লেখক হওয়া যায় কোন্ পথে? আমি তাদের কখনো বলি ভাষার নিয়ম ও ব্যাকরণের কথা, কখনো শব্দবৈচিত্র ও বাক্যসৌন্দর্যের কথা; কখনো সাহিত্যের অলঙ্কার ও কবিতার ছন্দ-মাধুর্যের কথা! অনেক কথাই বলি, কিন্তু আসল রহস্য প্রকাশ করি না এবং হৃদয়ের ‘বদ্ধ দুয়ার’ উন্মুক্ত করি না। কেননা চারপাশে আমার যদিও অনেক কোলাহল এবং উপচে পড়া কৌতূহল; যদিও সবার হাতে কাগজ-কলম এবং লেখালেখির উৎসাহে কমতি নেই কোনরকম, কিন্তু মর্মজ্বালা যদি প্রকাশ করতে দাও তাহলে বলবো, আমি অপেক্ষা করেছি, প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছি এবং ‘আকাশের’ কাছে প্রার্থনা করেছি, কিন্তু একটি উন্মুক্ত বক্ষের এবং একটি প্রস্ফুটিত হৃদয়ের সন্ধান আজো পাইনি।

মেঘ না হলে তো বৃষ্টি হয় না, বাগান না হলে তো বসন্ত আসে না এবং প্রস্ফুটিত হৃদয় না হলে তো হৃদয় থেকে রহস্য উন্মোচিত হয় না। হৃদয়ের ভাব হৃদয়ে তখনই প্রবেশ করে এবং হৃদয়ের মিনতি হৃদয়কে তখনই স্পর্শ করে যখন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন ঘটে। কিন্তু সেই শুভলগ্ন এখনো আসেনি আমার জীবনে।

নিঃসঙ্গ জীবনের এ বিষণ্ন সন্ধ্যায় আজ আমি ভাবছি, আমার দৃষ্টি-সীমার বাইরে দূর দিগন্তে- যেখানে আকাশ নেমে এসেছে পৃথিবীর কোলে- সেখানে নিশ্চয় আছে এমন কোন তরুণ, যার আত্মার আকুতি এবং হৃদয়ের মিনতি আমি শুনতে পাই না, কিন্তু সাহিত্যের সাধনায় সে উৎসর্গিত হতে চায় এবং আগামী দিনের কলম-জিহাদের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়। হে তরুণ! হে নবারুণ! তোমারই উদ্দেশ্যে আমার আজকের এ নিবেদন।

তুমি সাহিত্যের সাধক হতে চাও! সাহিত্যের অনন্ত জগতে প্রবেশ করতে চাও! তাহলে দুয়ার খোলো, হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। শব্দের রাজ্য জয় করে হৃদয়ের পথে প্রবেশ করো ভাবের জগতে। কেননা শব্দের রাজ্যে তুমি পাবে শুধু লেখার উপাদান, আর ভাবের জগতে পাবে সাহিত্যের সন্ধান। চিন্তার সংকীর্ণতা বর্জন করো এবং হৃদয়ের উদারতা অর্জন করো। কেননা উদার হৃদয়েই শুধু ভাবের আবির্ভাব হয়, সংকীর্ণ হৃদয়ে নয়। তোমাকে যারা কষ্ট দেয় তাদের তুমি ক্ষমা করো; তোমার চোখ থেকে যারা অশ্রু ঝরায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করো এবং ছুঁড়ে দেয়া পাথরকে ফুলরূপে গ্রহণ করো। তখন তোমার চোখের অশ্রু কলমের কালি হয়ে ঝরবে; তোমার কলমের ‘অশ্রুবিন্দু’ শব্দের মুক্তা হয়ে বর্ষিত হবে।

তোমার চিন্তায় যেন ঈর্ষা ও বিদ্বেষ না থাকে; তোমার হৃদয়ে যেন সবার প্রতি ভালবাসা থাকে, যে ভালোবাসা হবে জাগতিক সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে; যে ভালোবাসা শুধু দান করে এবং দানের আনন্দেই তৃপ্ত থাকে, কখনো প্রতিদান কামনা করে না; যে ভালোবাসা শুধু বিলিয়ে দেয়, কিছু কুড়িয়ে নেয় না; বিলিয়ে দেয়ার উচ্চতা থেকে কুড়িয়ে নেয়ার নীচতায় নেমে আসে না।

শত্রুকে যেন তুমি ক্ষমাসুন্দর হাসি উপহার দিতে পারো; সকল ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তুমি যেন উঠতে পারো। তখন প্রকৃতির কাছ থেকে তুমি একটি তন্ময়তা লাভ করবে। তোমার উপর ‘পরম সত্তা’র অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। তোমার হৃদয় থেকে ভাবের অনিঃশেষ ঝর্ণাধারা উৎসারিত হবে। স্রষ্টার আদেশে সৃষ্টিজগৎ তাদের অকৃপণ দানে তোমাকে ধন্য করবে। তখন পাতার সবুজ থেকে, ফুলের সুবাস থেকে, পাখির গান থেকে, নদীর কল্লোল থেকে এবং বৃষ্টির রিমঝিম থেকে তুমি লেখার প্রেরণা পাবে।

ভোরের আলো থেকে, সন্ধ্যার আঁধার থেকে, দিগন্তের লালিমা থেকে, আকাশের নীলিমা থেকে, মেঘের আল্পনা থেকে, চাঁদের জোসনা থেকে, তারকার ঝিলিমিলি থেকে এবং জোনাকির আলোকসজ্জা থেকে তুমি চিন্তার স্নিগ্ধতা লাভ করবে।

যখন আঘাত আসে, যখন ব্যথা জাগে তখন প্রত্যাঘাত না করে, কোন অভিযোগ না তুলে তুমি শান্ত হও, সংযত হও এবং তোমার কলমের আশ্রয় গ্রহণ করো। কলম তোমাকে শব্দের ফুল দিয়ে লেখার মালা গেঁথে পরম সান্ত্বনা দান করবে। আর কলমের যা কিছু দান তা রাব্বুল কলমের ইহসান। কারণ মানুষকে তিনি শিক্ষা দান করেছেন কলমের মাধ্যমে। সুতরাং কলমের দান পেতে হলে তোমাকে যেতে হবে রাব্বুল কলমের দুয়ারে, চাইতে হবে দু’হাত পেতে।

শোনো বন্ধু! তুমি যদি শুধু কলম চালনা করো, তাহলে কলম তোমাকে পরিচালনা করবে, কখনো এদিকে, কখনো সেদিকে, কখনো ঠিক পথে, কখনো ভুল পথে। কলমের অনুশীলনে তুমি শুধু লেখক হতে পারো, সাহিত্যের সাধক হতে পারো না। এ জন্য প্রয়োজন কলমের সঙ্গে কলবের বন্ধন। কলম ও কলব, এদু’য়ের শুভমিলনেরই নাম সাহিত্যের সাধনা। তুমি যদি হতে পারো এদু’য়ের মিলনক্ষেত্র তাহলে তুমি পেয়ে গেলে মহাসত্যের আলোকরেখা। তোমাকে করতে হবে না আর পথের সন্ধান। পথ নিজে ডাকবে তোমাকে। তুমি শুধু চলবে সামনে, আরো সামনে এবং পৌঁছে যাবে আলোর ঝর্ণাধারার নিকটে। তোমার কলম থেকে ঝরবে আলোর শব্দ, আলোর মর্ম।


কারণ লেখা তো কিছু নয়, শুধু রেখা। তাতে তুমি পারে না সত্যের দেখা। জীবনসফরে কলমের পথে সত্যের দেখা যদি পেতে চাও তাহলে আগে, সবার আগে কলমের স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করো।

হৃদয় যদি স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিতে পারে এবং হৃদয় যদি সৃষ্টির সৌন্দর্যের বাণী শ্রবণ করতে পারে তাহলে তোমার সামনে পরম সত্যের প্রকাশ এবং সুপ্ত রহস্যের উদ্ভাস ঘটবে। তোমার কলম জীবন্ত হবে, সৃজনশীল হবে। সাহিত্যের সাধনায় তুমি সফল হবে। তোমার সাহিত্য সত্য ও সুন্দরের এবং শুভ ও কল্যাণের ধারক হবে।

সূত্রঃ  দারুল কলম প্রকাশিত "এসো কলম মেরামত করি" গ্রন্থ