ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরীয়ার ধারণাসমূহ

সকল ইসলামি ব্যাংক এবং আইবিএস ব্যাংক শরীয়াহভিত্তিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য এবং শরীয়াহ অনুযায়ী কার্যাবলী পরিচালনার জন্য ‘শরীয়াহ কমিটি’ গঠন করে। এছাড়া শরীয়াহর দর্শন ও বাস্তবায়নে সমতা রাখার লক্ষ্যে মালয়েশিয়ায় গঠিত সর্বোচ্চ শরীয়াহ সংস্থা ‘শরীয়াহ উপদেষ্টা কাউন্সিল’ এর নির্দেশনা অনুসরণ করা যায়।‘শরীয়াহ কমিটি’ এবং ‘শরীয়াহ উপদেষ্টা কাউন্সিল’ এর সকল সদস্য শিক্ষাবিদ এবং ইসলামি ব্যাংকিং ও অর্থায়নে শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ।

সব ইসলামী ব্যাংক এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক শরীয়াহ্‌ ব্যাংকেরই শরীয়াহ কমিটি রয়েছে। শরীয়াহ কমিটি ব্যাংকের শরঈ বিষয়ে পথনির্দেশ করে এবং ব্যাংকের কার্‍্যক্রম শরীয়াহ অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করে।

সাধারণ শরঈ ধারণাসমূহ নিচে ব্যাখ্যা করা হলোঃ

ওয়াদীয়াহ

ওয়াদীয়াহ মানে কারো জিম্মায় বা নিরাপত্তায় রাখা। এই পদ্ধতিতে আপনি নগদ অর্থ অথবা অন্যান্য সম্পদ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে জমা রাখতে পারেন। ব্যাংক রক্ষিত সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এটা এভাবে কাজ করেঃ

১। গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা রাখে এবং ব্যাংক তা তাকে ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়।

২। গ্রাহক যে কোনো সময় তা তুলতে পারে।

৩। ব্যাংক গ্রাহকের সম্পদ দেখাশুনার জন্য চার্জ নিতে পারে এবং উপযুক্ত মনে করলে গ্রাহককে হিবা বা উপহারও দিতে পারে।

৪। এই ধারণাটি সাধারণত আমানত সংগ্রহ এবং নিরাপদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

 মুদারাবাহ

মুদারাবাহ হচ্ছে দুই পক্ষ অর্থাৎ বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তার মধ্যে মুনাফা ভাগ করে নেয়ার পদ্ধতি। বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাকে তার ব্যবসায়ের জন্য মূলধন সরবরাহ করে এবং এ থেকে অর্জিত মুনাফা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করে নেয়।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে মুদারাবাহর নীতি দুইভাবে প্রয়োগ করা হয়- ব্যাংক (উদ্যোক্তা হিসবে) এবং মূলধন সরবরাহকারীর মধ্যে এবং ব্যাংক (মূলধন সরবরাহকারী হিসেবে) এবং উদ্যোক্তার মধ্যে। লোকসান বা ক্ষতি মূলধন সরবরাহকারী বহন করে।

এটা এভাবে কাজ করেঃ

১। গ্রাহক মুদারাবাহর শর্তসমূহে সম্মত হয়ে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে।

২। ব্যাংক সেই অর্থ বিভিন্ন সম্পদে অথবা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে।

৩। ব্যবসায়ে লাভ হতে পারে আবার ক্ষতিও হতে পারে।

৪। লাভ হলে তা গ্রাহক এবং ব্যাংকের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করা হয়।

৫। ক্ষতি হলে তা গ্রাহক বহন করে। ক্ষতি হলে সম্পদ/বিনিয়োগের মূল্য কমে যাবে এবং গ্রাহকের জমাকৃত অর্থের পরিমাণও কমে যাবে।

বাই বিসামান আজিল BBA (বিক্রয়োত্তর মূল্য পরিশোধ)

এই পদ্ধতিতে বিক্রেতা ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করে এই শর্তে যে ক্রেতা পণ্য বুঝে পাওয়ার পর পূর্বনির্ধারিত লাভসহ পণ্যমূল্য একবারে অথবা কিস্তিতে পরিশোধ করবে। এটা এভাবে কাজ করেঃ

১। গ্রাহক তার পছন্দমতো পণ্য অথবা সম্পদ বাছাই করে।

২। এরপর গ্রাহক তার ব্যাংকে BBA-এর জন্য আবেদন করে এবং ব্যাংকের কাছ থেকেই ঐ পণ্য বা সম্পদ নির্ধারিত লাভসহ পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে কেনার চুক্তি করে।

৩। ব্যাংক পণ্যটির বর্তমান মালিকের কাছ থেকে তা নগদে কিনে নেয়।

৪। এভাবে পণ্যটির মালিকানা ব্যাংকের কাছে চলে আসে।

৬। ব্যাংক পণ্যটি লাভসহ মূল্যে গ্রাহকের নিকট বিক্রয় করে এবং মালিকানা গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করে।

৫। গ্রাহক লাভসহ পণ্যটির মূল্য কিস্তিতে ব্যাংককে পরিশোধ করে।

 মুরাবাহা

BBA-এর মতো মুরাবাহাতেও ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত লাভের বিনিময়ে পণ্য বিক্রি হয়। তবে এক্ষেত্রে বিক্রেতা পণ্যের প্রকৃত ক্রয়মূল্য এবং লাভের পরিমাণ ক্রেতাকে বিক্রয় চুক্তির সময় জানাতে বাধ্য থাকে।

মুশারাকা (যৌথ উদ্যোগ)

ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুশারাকা বলতে মুনাফার উদ্দ্যেশ্যে স্থাপিত অংশীদারী অথবা যৌথ ব্যবসায় উদ্যোগকে বোঝায়। অর্জিত মুনাফা নির্ধারিত অনুপাতে অংশীদারদের মধ্যে ভাগ করা হয়। মুনাফা বন্টনের অনুপাত অংশীদারদের মূলধন অনুযায়ী হওয়া জরুরী নয় তবে ক্ষতি হলে তা মূলধন অনুপাতে ভাগ করা হয়।

ইজারা সুম্মা বাই (ভাড়া ক্রয়)

ইজারা সুম্মা বাই সাধারণত ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে মোটরগাড়ি কেনার অর্থায়নে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে দুইটি পৃথক চুক্তি করা হয়ঃ ইজারা/ভাড়া চুক্তি এবং বাই (ক্রয়) চুক্তি। চুক্তিগুলো ধাপে ধাপে সম্পাদন করা হয় যা নিচের ডায়াগ্রামে দেখানো হয়েছে।

এটি এভাবে কাজ করেঃ

১। গ্রাহক তার পছন্দমতো গাড়ি বাছাই করে।

২। গ্রাহক ব্যাংকের কাছে গাড়িটি লীজ দেয়ার আবেদন করে, গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আমানত রাখে এবং ব্যাংক গাড়িটি কেনার পর তা লীজ নেয়ার চুক্তি করে।

৩। ব্যাংক গাড়িবিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধ করে।

৪। গাড়ির মালিকানা ব্যাংকের কাছে চলে আসে।

৫। ব্যাংক গাড়িটি গ্রাহককে লীজ দেয়।

৬। গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে লীজ ভাড়া ব্যাংককে পরিশোধ করে।

৭। ইজারার মেয়াদ শেষে ব্যাংক নির্ধারিত মূল্যে গাড়িটি গ্রাহকের কাছে বিক্রয় করে।

 ওয়াকালা (প্রতিনিধিত্ব)

এটা একধরণের চুক্তি যেখানে এক পক্ষ অপর পক্ষকে কোন নির্দিষ্ট কাজের জন্য তার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। যে ব্যক্তি কাজটির দায়িত্ব নেয় তাকে বলা হয় প্রতিনিধি এবং তাকে তার কাজের জন্য ফি বা সম্মানী দেয়া হয়।

উদাহরণ

একজন গ্রাহক ব্যাংককে প্রস্তাব দেয় একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে অর্থ পরিশোধ করার জন্য। এক্ষেত্রে ব্যাংক এই আর্থিক লেনদেনটি সম্পাদন করার প্রতিনিধি এবং ব্যাংক একাজের জন্য ফি নিয়ে থাকে।

কর্জ (বিনিময়বিহীন ঋণ)                                                                       

এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে শুধু তার সুনামের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দেয়া হয় এবং ঋণগ্রহীতাকে শুধু ঋণের সমপরিমাণ অর্থই পরিশোধ করতে হয়। তবে ঋণগ্রহীতা চাইলে অতিরিক্ত কিছু অর্থ (যা দিতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নন) ঋণদাতাকে ধন্যবাদ হিসেবে দিতে পারেন।

উদাহরণ

একজন ঋণদাতা যিনি একজন ঋণগ্রহীতাকে ৫,০০০ টাকা কর্জ হিসেবে দিলেন তিনি শুধু ৫,০০০ টাকাই ফেরত পাওয়ার দাবিদার।

হিবা (উপহার)

কেউ খুশি হয়ে কারো কোন উপকারের বিনিময়ে কিছু প্রদান করলে তাকে হিবা বলে।

উদাহরণ

ওয়াদিয়াহ নীতিতে পরিচালিত সঞ্চয়ী হিসাবে ব্যাংক সাধারণত হিবা দিয়ে থাকে যদিও হিসাবধারীরা শুধু নিরাপত্তার জন্যই এধরণের হিসাব খুলে থাকে।

সূত্রঃ islamicfinanceinfo.com.my