জিহাদ আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা
৮১৪ বার পঠিত
ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (১৯৩৫-২০১৬) ছিলেন একজন শীর্ষ স্থানীয় আলেম, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। মোমেনশাহী জেলার গফরগাঁও উপজেলাধীন আনসার নগর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মাওলানা খানের পিতা বিশিষ্ট সাধক পুরুষ, প্রবীণ শিক্ষাবিদ মৌলভী হাকিম আনছার উদ্দিন খান। তাঁর মাতা মোছাঃ রাবেয়া খাতুন। নিজ গ্রামের পাঁচবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৫১ সালে আলিম ও ১৯৫৩ সালে স্কলারশিপসহ ফাজিল পাস করেন। ১৯৫৩ সালে উচ্চশিক্ষার্থে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৫ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ সালে ফিক্হ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন।
মাদ্রাসায়ে আলীয়া ঢাকায় থাকাবস্থায়ই তিনি সাপ্তাহিক কাফেলা, সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম, দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক আজাদ ও দৈনিক মিল্লাত প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা-লেখির অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক পাসবানের শিক্ষানবীস লেখকরূপে পরে জীবিকার টানে ১৯৫৫ ঈসায়ী সনের শেষের দিকে কামেল পরীক্ষার পর দৈনিক পাসবান পত্রিকায় কাজ করেন।
গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার এ টি এম আবদুল মতীনের সহযোগিতায় ‘দারুল উলুম ইসলামী একাডেমি’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ রাখা হয়।
তিনি বিশ্ব মুসলিম লীগ ‘রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের প্রধান, বাদশাহ ফাহাদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প মদীনা মুনাওয়ারাহ সৌদি আরব কর্তৃক মুদ্রিত তাফসীরে মারেফুল কোরআন এর বাংলা অনুবাদক ছিলেন।
তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি কালজয়ী পত্রিকা মাসিক মদীনা সম্পাদক (১৯৬১), মাসিক মদীনা পরিবারের গৌরবদীপ্ত আলোকবর্তিকা, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদনা পরিষদের চেয়ারম্যান, রাবেতা আলম আল ইসলামীর কাউন্সিলর, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি হাসপাতালের কেন্দ্রীয় সদস্য, মুতামার আল আলম আল ইসলামী এর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নাস্তিক--মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামী মোর্চার সভাপতি, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রধান।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ২০০৫ সালের ৯ ও ১০ মার্চ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ‘ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির ব্যানারে টিপাইমুখ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। এতে দেশের প্রায় ৩০টি সংগঠন যোগদান করে।
অসহায়, দরিদ্র ও ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সম্বলহীন লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণসহ সার্বিক কল্যাণে তিনি কাজ করে গেছেন। বান্দরবন জেলার কয়েক শ’ উপজাতি পরিবার তাঁর সহযোগিতায় ইসলাম গ্রহণ করে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে তিনি ‘তাওহিদ মিশন’ নামক সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেন।
প্রতিভাধর মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি প্রায় ২০০ খানা গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। তার সম্পাদিত ‘মাসিক মদীনা’র প্রশ্নোত্তর সঙ্কলন ‘সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব’ ২০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদের মধ্যে বিশেষত, (১) মা’রেফুল কুরআন – মুফতি শফী (৮ খন্ডে) (২) আল্লামা শিবলী নুমানী ও সাইয়েদ সুলাইমান নোমানীর “সীরাতুন্নবী” (৩) ইমাম গাজ্জালীর “ইয়াহইয়া উলুম আদ-দ্বীন” (৫ খন্ডে) (৪) আল্লামা শিবলী নুমানীর “ফারুক” (৫) ইমাম আবুল আব্বাস জয়নুদ্দীন হানাফীকৃত “তাদরিজুল বুখারী” (৬) আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতীর ২ খন্ডে “ খাসায়েসুল কুবরা” (৭) মাওলানা হামিদ নদভীকৃত ইমাম গাজ্জালির “তাসাওফ ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা” অন্যতম।
তাঁর নিজের উল্লেখযোগ্য লিখিত বই এর মধ্যে কিছু হোলোঃ (১) প্রিয় নবীর প্রিয় প্রসঙ্গ (২) স্বপ্নযোগে রাসূল সা (৩) মাকতুবাতে ইমাম গাজ্জালী (৪) কুড়ানো মানিক (৫) ইমাম যাইনুল আবেদীন (৬) সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব (২০ খন্ডে) (৭) হাসানুল বান্নার রচনাবলী (৮) প্রিয় নবীর অন্তরঙ্গ জীবন (৯) আজাদী আন্দোলন (১০) বাংলা শিক্ষা – বাংলা একাডেমী (১১) কুরআন পরিচিতি (১২) ইসলাম ও সমকালীন বিস্ময়কর ঘটনাবলী (১৩) হাদীসে রাসূল (১৪) হৃদয়তীর্থ মদিনার পথে (১৫) মৃত্যু ও পরকাল প্রসঙ্গ।
দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরুষ্কারের মাঝে বিশেষ হোলোঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরুষ্কার, নিওয়ানো পিস এওয়ার্ড (জাপান), তমদ্দুন মজলিসের শান্তি পুরুষ্কার, জাতীয় ব্যক্তিত্ত্ব সংবর্ধনা (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমী), বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য সাপ্তাহিক গতি (কলিকাতা), গুণীজন সংবর্ধনা পুরুষ্কার পদক (মাওলানা ভাসানী রিসার্চ একাডেমী) এবং সিরাত চর্চার জন্য সিরাত স্বর্ণ পুরষ্কার উল্লেখযোগ্য।