হাদীসের প্রথম প্রকার শ্রেণী বিভাগ
হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ হাদীসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- ১. কাওলী ২. ফে’লী ৩. তাকরীরি। কাওলীঃ আদেশ, নিষেধ অথবা অন্যান্য যত প্রকার মৌখিক বর্ণনা আছে তাকে ‘হাদীসে কাওলী’ বলে। উদাহরণঃ হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন হযরত রাসূলে করীম (স.) বলেছেন- ফাসেক ব্যক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হলে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন এবং এ কারণে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। [বায়হাকী] এই হাদীসটি রাসূল (স.)-র একটি বিশেষ কথার উল্লেখ থাকার কারণে এটা কাওলী হাদীস।
ফে’লীঃ কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার, উঠা-বসা, লেন-দেন সম্পর্কীয় কথাগুলোকে ‘হাদীসে ফে’লী বলে। উদাহরণঃ হযরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলে করীম (স.) কে মোরগের গোস্ত খেতে দেখেছি। (বোখারী ও মুসলিম) এই হাদীসটিতে রাসূলের (স.)-র একটি কাজের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই জন্য এটি ‘হাদীসে ফে’লী’।
তাকরীরিঃ অনুমোদন বা সমর্থন জ্ঞাপন সূচক হাদীস। দেখা গেছে অনেক সময় সাহাবীগণ অনেক কাজ করেছেন, যে কাজের ব্যাপারে রাসূল (স.) সমর্থন দিয়েছেন অথবা মৌনতার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এই ধরনের হাদীসকে ‘তাকরীরী হাদীস’ বলে।
হাদীসের দ্বিতীয় প্রকার শ্রেণী বিভাগ বর্ণনাকারীদের (রাবী) সিলসিলা অনুযায়ী হাদীসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ক. মারফু খ. মওকুফ গ. মাকতু
মারফুঃ যে হাদীসের সনদ বা সূত্র নবী করীম (স.) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে ‘মারফু হাদীস’ বলে। অর্থাৎ যে সূত্রের মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা, কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে, সে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূল করীম (স) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হয়েছে এবং মাঝখান থেকে একজন বর্ণনাকারীও বাদ পড়েনি তা ‘হাদীসে মারফু’ নামে পরিচিত।
মওকুফঃ যদি কোন হাদীসের সনদ রাসূল (স). পর্যন্ত না পৌঁছে, সাহাবী পর্যন্ত গিয়েই স্থগিত হয়- অর্থাৎ যা স্বয়ং সাহাবীর হাদীস বলে সাব্যস্ত হয় তাকে ‘হাদীসে মওকুফ’ বলে।
মাকতুঃ যে হাদীসে রাবীদের ধারাবাহিকতা কোন তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ তাবেয়ীর হাদীস বলেই প্রমাণিত হয়েছে তাকে ‘হাদীস মাকতু’ বলে।
হাদীসের তৃতীয় প্রকার শ্রেণী বিভাগ
রাবীদের বাদ পড়ার দিক থেকে হাদীস দু’প্রকার যথা : ১. মোত্তাছিল ২. গায়ের মোত্তাছিল। মোত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা ওপর হতে নীচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত হয়েছে, কোন রাবী বাদ বা উহ্য থাকেনি তাকে মোত্তাসিল বলে।
গায়ের মোত্তাসিলঃ সূত্র অসংলগ্ন অর্থাৎ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, কোন না কোন স্থানের রাবী বাদ পড়েছে বা উহ্য রয়েছে এ ধরনের হাদীসকে ‘গায়ের মোত্তাসিল’ বলে। হাদীস গায়ের মোত্তাছিল আবার কয়েক প্রকারঃ ক. মু’আল্লাক খ. মুরসাল গ. মুনকাতা ঘ. মুদাল্লাস ঙ. মো’দাল।
মু’আল্লাক: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি প্রথম অংশেই রাবী বাদ পড়ে যায় তবে তাকে ‘মু’আল্লাক হাদীস’ বলে।
মুরসাল: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি সনদের শেষাংশের রাবীর নাম বাদ পড়ে যায় তবে তাকে ‘মুরসাল’ বলে।
মুনকাতাঃ অসংলগ্ন সূত্রের অর্থাৎ বর্ণনার সময় রাবী বাদ পড়েছে এমন যে কোন হাদীসকে ‘মুনকাতা’ বলা যায়। ইনকাতা শব্দের আভিধানিক অর্থ ছিন্ন হওয়া। অতএব প্রত্যেক ছিন্ন সূত্রের হাদীসকে ‘মুনাকাত’ বলা যেতে পারে।
মো’দালঃ হাদীস বর্ণনার সময় যদি সনদ থেকে দুই বা ততোধিক রাবী বাদ পড়ে যায় তবে কাকে মো’দাল বলে।
মুদাল্লাসঃ যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের নাম না করে তাঁর ওপরস্থ শায়খের নামে এরূপভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় তিনি নিজেই তা উপরিউক্ত শায়খের নিকট থেকে শুনেছেন অথচ তিনি নিজে তা তাঁর নিকট থেকে শুনেননি (বরং তা তাঁর প্রকৃত উস্তাদের নিকট শুনেছেন) সে হাদীসকে মুদাল্লাছা বলে এবং এইরূপ করাকে ‘তাদলীস’ বলে। আর যিনি এইরূপ করেছেন তাঁকে ‘মুদাল্লেছ’ বলে। মুদাল্লেসের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়- যে পর্যন্ত না তিনি একমাত্র ছেকাহ রাবী হতে তাদলীছ করেন বলে সাব্যস্ত হন অথবা তিনি তা আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিস্কারভাবে বলে দেন।
বর্ণনার দুর্বলতার জন্য হাদীসের প্রকারভেদ
এ ধরনের হাদীস আবার কয়েক প্রকার- ১. মুজতারাব ২. মুদরাজ ৩. মাকলুব ৪. শাহ’জ ৫. মুনকার ৬. মুআল্লাল।
মুজতারাবঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় সনদ ওলট পালট করে ফেলেন-যেমন আবু হুরাইরার স্থানে আবু যুবাইর বললেন বা এক স্থানের শব্দ অন্য স্থানে লাগালেন অথবা একজনের নিকট একটি হাদীস একরকম বর্ণনা করে অন্য লোকের নিকট ঐ হাদীসই আবার আরেক রকম বর্ণনা করলেন এই ধরনের হাদীসকে ‘মুজতারাব’ বলে। এটা গ্রহণযোগ্য হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত না এর সঠিকতা প্রমাণিত হয়।
মুদরাজঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনা করার সময় নিজের কথা অথবা অন্য কারো কথা শামিল করে দেয় তাঁর সেই হাদীসকে ‘মুদরাজ’ বলে। আর এইরূপ করাকে ‘ইদরাজ’ বা শামিল করা বলে। যদি ঐ কথা হাদীসের কোন শব্দকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় তা’হলে তা জায়েয, নতুবা হারাম।
মাকলুবঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় এক মতনের সনদকে অন্য মতনে জুড়ে বর্ণনা করেন তবে তাকে ‘মাকলুব’ বলে।এরূপ কোন ঘটনা ঘটলে ঐ রাবীর স্মরণ শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এ প্রকার রাবীর বর্ণনাকৃত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যাচাই বাছাই করার পর গ্রহণ করা যেতে পারে।
মাহফুজ ও শা’জঃ কোন ছেকাহ রাবীর হাদীস অপর কোন ছেকাহ-রাবী বা রাবীগণের হাদীসের বিরোধী হলে, যে হাদীসের রাবীর ‘জবত’ গুণ অধিক বা অপর কোন সূত্র দ্বারা যার হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায় অথবা যার হাদীসের শ্রেষ্ঠত্ব অপর কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তাঁর হাদীসটিকে হাদীসে মাহফুজ এবং অপর রাবীর হাদীসটিকে হাদীসে শা’জ বলে এবং এরূপ হওয়াকে ‘শুজুজ’ বলে। ‘শুজুজ’ হাদীসের পক্ষে একটি মারাত্মক দোষ। শা’জ হাদীস সহীহ রূপে গ্রহণ নহে।
মুনকারঃ জবত গুণ সম্পন্ন নয় এরূপ কোন ব্যক্তি এমন কোন হাদীস বর্ণনা করলো যা অন্য কারো নিকট থেকে শোনা যায়নি এরূপ হাদীসকে ‘মুনকার’ হাদীস বলে। যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়েছে অথবা কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত রয়েছে এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসকে ‘মাতরুক’ বা পরিত্যক্ত হাদীস বলে।
মু-আল্লালঃ যে হাদীসের ভেতর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ত্রুটি থাকে যা হাদীসের সাধারণ পণ্ডিতগণ ধরতে পারে না, একমাত্র সুনিপুণ শাস্ত্র বিশারদ ব্যতিরেকে। এই প্রকার হাদীসকে ‘মু-আল্লাল’ বলে। এ রূপ ত্রুটিকে ‘ইল্লত’ বলে। ‘ইল্লত’ হাদীসের পক্ষে মারাত্মক দোষ, এমনকি ‘ইল্লত’ যুক্ত হাদীস সহীহ হতে পারে না।
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদীসের শ্রেণী বিভাগ
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদীস তিন প্রকার- ১. সহীহ ২. হাসান ৩. জয়ীফ
সহীহঃ যে মুত্তাসিল সনদের রাবীগণ প্রত্যেকেই উত্তম শ্রেণীর আদিল ও জাবিতরূপে পরিচিত অর্থাৎ ছেকাহ হওয়ার শর্তাবলী তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে বিরাজমান, মূল হাদীসটি সূক্ষ্ণ দোষ ত্রুটি অথবা শা’জ বা দল ছাড়া হতে মুক্ত এরূপ হাদীসকে ‘সহীহ হাদীস’ বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র ধারাবাহিক রয়েছে, সনদের প্রত্যেক স্তরের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরূপে উল্লেখিত হয়েছে, বর্ণনাকারীগণ সর্বোতভাবে বিশ্বস্ত ছেকাহ যাঁদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাঁদের সংখ্যা কোনো স্তরেই মাত্র একজন হয়নি, এরূপ হাদীসকে হাদীসে সহীহ বলে।
সহীহ হাদীসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম নববী বলেছেন- “যে হাদীসের সনদ নির্ভযোগ্য ও সঠিক রূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনাকারকদের সংযোজনে পরস্পরাপূর্ণ ও যাতে বিরল ও ত্রুটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নেই, তাই ‘হাদীসে সহীহ’।
হাসানঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর মধ্যে সকল গুণ বর্তমান তাকা সত্ত্বেও যদি স্মরণ শক্তির কিছুটা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়, তবে সেই হাদীসকে ‘হাদীসে হাসান’ বলে।
জয়ীফঃ উপরিউক্ত হাদীসে সহীহ ও হাদীসে হাসানে বর্ণিত গুণগুলি যদি সনদ বর্ণনাকারী রাবীদের মধ্যে কম পরিলক্ষিত হয় তবে তাকে ‘হাদীসে জয়ীফ’ বলে। [এখানে ভুল বুঝার অবকাশ আছে, এ জন্য তা থেকে মুক্ত করার মানসে হাদীসের ব্যাখ্যা মেশকাত শরীফ থেকে দেয়া হলো- রাবীর ‘জোফ’ বা দুর্বলতার কারণেই হাদীসটিকে জয়ীফ বলা হয়, অন্যথায় (নাউজুবিল্লাহ) রাসূলের কোন কথা জয়ীফ নয়। জয়ীফ হাদীসের জো’ফ কম ও বেশী হতে পারে। খুব কম হলে তা হাসানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশী হলে তা একেবারে মাওজুতে পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদীস আমলের ফজিলত বা আইনের উপকারিতায় ব্যবহার করা যেতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়।]
বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক দিয়ে হাদীসের বিভাগ
হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সকল ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এক রকম হয়নি। কখনো কম কখনো বা বেশী হয়েছে। এ জন্য এর ভিত্তিতে শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে। মুতাওয়াতিরঃ যে হাদীসের সনদের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত অধিক যে, তাঁদের সম্পর্কে মিথ্যা হাদীস রচনার অভিযোগ আনা অসম্ভব বলে মনে হয়। এই ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলে।
মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে- ‘যে কোন সহীহ হাদীসকে যুগে যুগে এত অধিক পরিমাণে লোকেরা বর্ণনা করছেন যে, একটি মিথ্যা কথার পক্ষে এত সংখ্যক লোক দলবদ্ধ হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব মনে করে, আবার সকলে এক অঞ্চলের লোক নন, বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন গোত্রের লোক। পরস্পরের মধ্যে তেমন যোগাযোগের কোন ব্যবস্থাই কোন কালে হয় নি। আবার রাবীগণের সংখ্যা সকল যুগে একই প্রকার রয়ে গেছে, কোন যুগে কমে এমন দাঁড়ায় নি যে সংখ্যাগুলি একত্র হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব ও অস্বাভাবিক মনে করে না। আার তাঁরা যে কথাটি সংবাদ স্বরূপ পৌঁছে, তা দৃষ্ট ও বাস্তব অনুভূতি পক্ষান্তরে তা কোন ধারনামূলক বস্তু ও সম্ভাবনামূলক নয়। এমন হাদীসকে ‘খবরে মোতাওয়াতির’ বলে।
খবরে মোতাওয়াতির আবার দু’প্রকার ১. লফ্জি ও ২. মা’নবি।
লফ্জিঃ মোতাওয়াতির লফ্জি ঐ হাদীসকে বলে যার শব্দগুলিও যুগে যুগে একই প্রকারের রাবীগণ কর্তৃক আবৃত্তি হয়ে আসছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (স.) এর বাণীটি ‘সাতারাওনা রাব্বুকুম’ অর্থাৎ নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রভূকে দেখবে।
মা’নবিঃ মোতাওয়াতির মা’নবি ঐ সমস্ত হাদীসকে বলে, যে হাদীসে কোন একটি ঘটনাকে বহুলোক বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এ ধরনের বিভিন্নতা সত্ত্বেও সকলকে একটি জায়গায় একমত হতে দেখা যায়। যেমন- কেউ বলেছেন, হাতেম তায়ী একশত উট দান করেছেন, কেহ বলেন আশিটি উট দান করেছেন, কেউ বলেন নব্বই, কেউ বলেন সত্তরটি। এই ভাবে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। অতএব সংখ্যার দিকে তাকালে এই হাদীসটি খবরে মোতাওয়াতির হতে পারে না কিন্তু একটি কথায় সবাইকে একমত দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে হাতেমতায়ী দানশীল ছিলেন। তাই এ হাদীসকে ‘মোতাওয়াতির মা’নবি’ বলা হয়েছে।
খবরে আহাদ এ ধরনের হাদীস আবার তিন প্রকার ১. গরীব ২. আজিজ ৩. মশহুর। গরীবঃ কোন সহীহ হাদীসের যদি বর্ণনাকারী একজন হন তবে তাকে ‘গরীব’ হাদীস বলে। আজিজঃ কোন সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী যদি দু’জন হন বা তার থেকে কম না হন তা’হলে ঐ প্রকার হাদীসকে ‘হাদীসে আজিজ’ বলে। মশহুরঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী মাত্র তিনজন বা তার থেকে কম নয় এ ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে মশহুর’ বলে।
এ ছাড়াও আরো তিন প্রকার হাদীস আছে, যথা- ১. মাওজু ২ মাত্রূক ৩. মোবহাম মাওজুঃ যে হাদীসের রাবী জীবনের কোন সময় রাসূলুল্লাহর (স.) নামে ইচ্ছে করে কোন মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমাণ আছে- তাঁর হাদীসকে ‘হাদীসে মাওজু’ বলে। এ ধরনের ব্যক্তির কোন হাদীসই কখনো গ্রহণযোগ্য নয়- যদি সে অতপর খালেস তওবাও করে।
মাত্রূকঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের ব্যাপারে নয় বরং সাধারণ কাজকারবারে মিথ্যা কথা বলে খ্যাত হয়েছেন- তাঁর হাদীসকে হাদীসে মাতরূক বলে। এ ধরনের ব্যক্তির হাদীসও পরিত্যাজ্য। অবশ্য পরে যদি তিনি সত্যিকার অর্থে তওবা করেন এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য গ্রহণ করেন তা হলে তাঁর পরবর্তী কালের হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে।
মোব্হামঃ অপরিচিত রাবী অর্থাৎ যাঁর স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়নি, যাতে তাঁর দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে। - তাঁর হাদীসকে ‘হাদীসে মোব্হাম’ বলে। এ ধরনের ব্যক্তি সাহাবী না হলে তাঁর হাদীস গ্রহণ করা যাবে না।
হাদীসে কুদসী
হাদীসের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বের দাবীদার এই হাদীসে কুদসী। এ হাদীসের মূল বক্তব্য সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত। কুদসী পদটি আরবী ‘কুদুস’ থেকে আগত, যার অর্থ পবিত্রতা, মহানত্ম।
সংজ্ঞাঃ যে হাদীসের মুল কথা সরাসরি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এসেছে সেই হাদীসকেই ‘হাদীসে কুদসী’ বলে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে ‘ইলহাম’ কিংবা স্বপ্ন যোগে এই মূল কথাগুলি জানিয়ে দিয়েছেন।
প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাদাতা মুল্লা আলী আল-কারী ‘হাদীসে কুদসী’র সংজ্ঞা দান প্রসংগে বলেছেন- ‘হাদীসে কুদসী’ সে সব হাদীস যা শ্রেষ্ঠ বর্ণনাকারী পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম নির্ভরযোগ্য হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর নিকট থেকে বর্ণনা করেন কখনো জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে জেনে কখনো সরাসরি অহী কিংবা ইলহাম বা স্বপ্ন যোগে লাভ করেন, যে কোন প্রকারের ভাষার সাহায্যে এটা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হয়ে থাকে।” (হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃঃ ৩৩)
এ সম্বন্ধে আল্লামা বাকী তাঁর ‘কুল্লিয়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন- “কোরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ, ভাব ও কথা সবই আল্লাহর নিকট থেকে সুস্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ; আর ‘হাদীসে কুদসীর’র শব্দ ও ভাষা রাসূলের; কিন্তু উহার অর্থ, ভাব ও কথা, আল্লাহর নিকট হতে ইলহাম কিংবা স্বপ্ন যোগ প্রাপ্ত।”
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারা গেলো যে, হাদীসে কুদসী ও কোরাআনের মধ্যে পার্থক্য কি? তবুও কিছু অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে, ছকের সাহায্য নিলে মনে হয় আমাদের জন্যে বুঝতে সুবিধা হবে।
কোরআন ও হাদীসে কুদসীর পার্থক্য
১. কোরআান মজীদ জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে ছাড়া নাযিল হয়নি এবং এর শব্দ ভাষা নিশ্চিত ভাবে ‘লওহে মাহফুজ’ থেকে অবতীর্ণ।
হাদীসে কুদসীর মূল বক্তব্য আল্লাহর নিকট থেকে ইলহাম কিংবা স্বপ্ন যোগে প্রাপ্ত। কিন্তু ভাষা রাসূল (স.)-এর নিজস্ব।
২. নামাজে কোরআন মজীদ’ই শুধু পাঠ করা হয়। কোরআন ছাড়া নামাজ সহী হয় না। নামাজে হাদীসে কুদসী পাঠ করা যায় না অর্থাৎ হাদীসে কুদসী পাঠে নামাজ হয় না।
৩. অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা হারাম। হাদীসে কুদসী অপবিত্র ব্যক্তি, এমন কি হায়েয নিফাস সম্পন্না নারীও স্পর্শ করতে পারে।
৪. কোআন মজীদ মু’জিজা কিন্তু হাদীসে কুদসী মু’জিজা নয়।
৫. কোরআন অমান্য করলে কাফের হতে হয়। হাদীসে কুদসী অমান্য করলে কাফের হতে হয় না।
৬. কোরআন নাযিল হওয়ার জন্যে আল্লাহ ও রাসূলের মাঝখানে জিবরাঈলের মধ্যস্থা অপরিহার্য। হাদীসে কুদসীর জন্য জীবরাঈলের মধ্যস্থা জরুরী নয়।
এতক্ষণে আলোচনায় আমরা বুঝতে পারলাম যে হাদীস প্রধানতঃ দু’ভাগে বিভক্ত - ১. হাদীসে নব্বী - রাসূলে করীম (স.)-এর হাদীস। ২. হাদীসে ইলাহী – আল্লাহর হাদীস, আর এই হাদীসকেই হাদীসে কুদসী বলে।
শায়খ মুহাম্মদ আল-ফারুকী হাদীসকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘হাদীসে কুদসী তাই, যা নবী করীম (স.) তাঁর আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে বর্ণনা করেন। আর যা সেরূপ করেন না, তা হীদসে নব্বী।’ (হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃঃ৩৬)
সূত্রঃ সুহৃদ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত “হাদীসের পরিচয়” গ্রন্থ