মুহাম্মাদ (সাঃ) কে সব মুসলমানরা ভালবাসে। অন্যান্য অনেকের কাছেই তিনি সম্মানিত ও শ্রদ্ধার পাত্র। আর তাঁকে ধর্মীয় ও জাগতিক বিষয়াবলীতেও প্রভাবশালী হিসেবে গণ্য করা হয়।
মহাত্মা গান্ধী এভাবে তাঁর বর্ণনা করেছেন যে তিনি ওয়াদা পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বন্ধু ও অনুসারীদের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, স্রষ্টার প্রতি অবিচল আস্থাশীল আর নিজের লক্ষ্যের প্রতি নির্ভীক ও নিঃশঙ্কচিত্ত। সারা বিশ্বের মুসলমানরা ইবাদত ও অন্যান্য ব্যাপারে তাঁকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য করে।
আমাদেরকে প্রিয়নবী (সাঃ) শিখিয়েছেন যে ইসলাম চায় আমরা প্রতিবেশির প্রতি দয়ার্দ্র ও সুন্দর ব্যবহার করি। ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে তারা সম্মান ও সুন্দর আচরণ পাবার হকদার। মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “জিবরাঈল (আঃ) মহানবী (সাঃ) কে প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে এতো অধিক জোর দিয়েছেন যে মহানবী (সা) বলেন- আমার মনে হচ্ছিল হয়ত প্রতিবেশীদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানানো হবে। এটিই ছিল প্রতিবেশীদের প্রতি দয়া ও সুন্দর আচরণের উপর তাঁর গুরুত্বারোপের নমুনা।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দায়িত্ব ছিল আল্লাহ্র বানী পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহ্ কুরআনে আদেশ করেছেন প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দর আচরণের। তিনি বলেনঃ
আর তোমরা আল্লাহ্র ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করোনা। পিতামাতার সাথে সৎ ব্যবহার কর এবং আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, দরিদ্রগণ, আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সহচর, পথিক ও মালিকানাধীন অন্যান্য সকলের সাথে সৎ ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অহংকারী আত্মাভিমানীদের পছন্দ করেন না। (সূরা নিসাঃ আয়াত ৩৬)
সাহাবারা সর্বদাই একে অপরকে আল্লাহ্র প্রতি কর্তব্য ও অন্যান্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। মহানবী (সাঃ) প্রায়ই তাঁদেরকে সৎ কাজ করার এবং কর্তব্য পালন করার উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন “যে আল্লাহ্ ও বিচার দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়”। তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দিতেন যে একজন আল্লাহ্তে বিশ্বাসী ব্যাক্তি কখনোই তার ভাই বা বোনের ক্ষুধার্ত কিংবা দুরাবস্থায় থাকা সহ্য করতে পারে না। এটা এমন কথা যা শুধু তাঁর সাহাবীদের জন্য নয় বরং আমাদের সকলের জন্য অনুসরনীয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা কী দেখি! অসহায় বৃদ্ধরা একাকী মারা যাচ্ছে কিংবা আমাদের প্রতিবেশীরা অভুক্ত থাকছে আমাদের কাছে খাবার থাকা সত্ত্বেও! এমন সময় আমাদেরকে আমাদের সালফে সালেহীনদের উদাহরনগুলো স্মরণ করা দরকার।
আবু যার (রাঃ) কে মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন যে তরকারীতে একটু বেশি করে পানি দাও যাতে করে তোমার প্রতিবেশীকে একটু দিতে পার। একদিন ভেড়া জবাই করার পর হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) তাঁর ভৃত্যকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে কিছু দিয়ে এসেছ?’ ঈমানদারদেরকে উপহার আদানপ্রদানের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে যদিও তা কম মূল্যের হয়। উপহারের আসল গুরুত্ব তো পারস্পরিক শুভ কামনায়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালবাসা বৃদ্ধি করে। হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন মহানবী সাঃ কে জিজ্ঞেস করলেন কোন প্রতিবেশীকে আমি উপহার দিব? তিনি বললেন যার বাড়ির দরজা সবচেয়ে কাছে। যদিও আমরা নিকটতম প্রতিবেশীর বেশি খোঁজখবর নিব কিন্তু ইসলাম চায় আমরা সকল প্রতিবেশীর ব্যপারে যত্নবান হই। এটা এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজের সকলের মানসিক কিংবা বস্তুগত সব ধরনের চাহিদা পূরণ হয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যাতে বৃহত্তর সমাজের সকলের চাহিদা ও অনুভূতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ইসলামের শিক্ষা যখন কেউ সত্যিকারভাবে বুঝতে পারে তখন তিনি দেখেন যে সমাজের একজন কষ্টে থাকলে পুরো সমাজই কষ্টে থাকে। পরিবারের বাইরে প্রতিবেশীর উপরই আমরা প্রয়োজনে বা বিপদে নির্ভর করে থাকি। প্রতিবেশীর সাথে খারাপ সম্পর্ক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশী সবাই একে অপরকে বিশ্বাস করবে ও নির্ভর করবে। এতে করে সবার নিজেদের সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তা বজায় থাকবে। মহানবী (সাঃ) বলেন একজন ভাল প্রতিবেশী মুমিন জীবনের আনন্দের উৎস। তিনি বলেন মুমিন জীবনে আনন্দের জিনিসগুলোর মাঝে রয়েছে সৎ প্রতিবেশী, প্রশস্ত বাড়ি ও ভাল বাহন।
একজন ভাল প্রতিবেশী তিনিই যিনি তাঁর প্রতিবেশীর সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার ব্যাপারে আপোষহীন। আল্লাহতে বিশ্বাসী ব্যক্তির জন্য এটা আবশ্যক যে তিনি প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মী ও সদাচারী হবেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রতিবেশীর ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন।
একদা প্রিয়নবী (সাঃ) এর নিকট এক নারীর ব্যাপারে বলা হল যিনি ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি প্রচুর নফল নামাজ, রোজা ও সদকা করেন আবার প্রতিবেশীর সাথে কর্কশ আচরণ করেন। তিনি বললেন, সে এ জন্য জাহান্নামী হবে। আরো এক নারীর ব্যাপারে বলা হল যিনি শুধু ফরজ ইবাদাতগুলো করেন আর অল্প পরিমান দান করেন এবং তিনি প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর আচরণ করেন আর কাউকে কষ্ট দেন না। তিনি বললেন সে জান্নাতি- ১৪০০ বছর পার হলেও আজকের জন্যও হাদিসটি প্রযোজ্য।
ইসলাম পারিবারিক বন্ধন, প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক ও বৃহত্তর সামাজিক ঐক্যের ব্যাপারে অনেক জোর প্রদান করেছে।
ইসলাম সর্বদাই মুমিনদেরকে প্রতিবেশীর প্রতি দয়ালু ও সহনশীল হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু যদি কারো এমন প্রতিবেশী থাকে যে অনাকাঙ্খিত আচরণ করে ও সম্মান বজায় রাখে না তবে তার সাথে আচরণ কেমন হবে? একজন মুসলিম এইসব ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করবে, সহনশীল হবে ও মনে কোন অসন্তোষ বয়ে বেড়াবে না। ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহ্র কাছ থেকে পুরষ্কারের আশায় সর্বদা সুন্দর ও ক্ষমাশীল আচরণের মাধ্যমে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের চেষ্টা করে যাবে। ধৈর্যের সাথে বিরক্তিগুলো চেপে যাবে। তবে পরিস্থিতি একদম খারাপ হয়ে গেলে এটা নিয়ে কথা বলা যাবে।
একবার মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে তার মালপত্র গুটিয়ে রাস্তার মাঝখানে আসতে বললেন যাতে করে এটি প্রকাশ পায় যে তার পক্ষে তার প্রতিবেশীর সাথে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ঘটনা দেখে সেই প্রতিবেশী ক্ষমা প্রার্থনা করল আর ওই ব্যক্তিকে ফিরে আসতে বলল। কোন ব্যক্তিই চায় না তার খারাপ আচরণগুলো প্রকাশ পাক। আর এটা একজন মুমিনের জন্য আরো বেশি সত্য যেখানে ইসলাম চায় মুসলিমরা হবে সর্বোচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন।
পারস্পরিক সম্মান, সহনশীলতা ও ক্ষমার উপর ইসলাম অনেক জোর প্রদান করেছে আর এই গুণগুলো প্রতিবেশীর প্রতি প্রদর্শন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।