আমি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা, আমার বুকে লুকিয়ে আছে অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রণা। বুকের ভিতরে আর কত দিন লুকিয়ে রাখবো বুকের বেদনা! নীরবে আর কতকাল সয়ে যাবো এ জ্বালা-যন্ত্রণা! কোন দিন কি আমি খুঁজে পাবো না একজন দরদী বন্ধু, যে শোনবে আমার ব্যথা ও যন্ত্রণার কথা, আমাকে দেবে একটু সামান্য শান্তি ও সান্ত্বনা!
ভাষা হলো ভালোবাসার মাধ্যম, ভাষা হলো চিন্তা ও চেতনার বাহন। আমার স্বপ্ন ছিলো, আমি হবো তোমাদের মুখের এবং কলমের ভাষা। আমার পঞ্চাশটি বর্ণ দ্বারা তোমরা লিখবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসার কথা; সেই ভালোবাসায় সিক্ত হবে তাদের হৃদয় যারা বাংলাভাষায় কথা বলে। আমার স্বপ্ন ছিলো, আমি হবো সত্যের, কল্যাণের এবং ন্যায়ের বাহন। আমার মাধ্যমে এদেশে এই সমাজে তোমার সত্যের চিন্তা প্রচার করবে, কল্যাণের ভাবনা ছড়িয়ে দেবে এবং ন্যায়-চেতনার বিস্তার ঘটাবে। আমি হবো পৃথিবীর সুখী ও সমৃদ্ধশালী এক ভাষা, যেমন ইরানের ফারসি এবং হিন্দুস্তানের উর্দূ ভাষা।
আমার কি যোগ্যতার অভাব ছিলো? ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের কমতি ছিলো? ভূষণে, অলঙ্কারে ও ধ্বনি-মাধুর্যে আমি তো ছিলাম অনন্য! তবু আমি পেলাম না তোমাদের যত্ন-ভালোবাসা! আদর পরিচর্যা!
আমার বাগানে কি ফুল ছিলো না! আমার ফুলে কি সুবাস ছিলো না! তবু তোমরা আমার কাছে এলে না, ফুল তুলে মালা গাঁথলে না।
আমি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা! আমার বুকে এখন শুধু হতাশা! আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, পরম সমাদরে তোমরা আমাকে গ্রহণ করবে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে আমাকে ব্যবহার করবে। তোমরা যখন বাতিলের বিরুদ্ধে লড়বে, তোমাদের কলম থেকে আমি আগুন হযে ঝরবো। কিন্তু তোমরা আমাকে গ্রহণ করলে না, বরং তুলে দিলে ইসলামের যারা শত্রু তাদের না-পাক হাতে। ওরা আমাকে বানালো নগ্নতা ও অশ্লীলতার বাহন এবং ভ্রান্তি ও গোমরাহির অন্ধকার ছড়ানোর মাধ্যম। মুখে ও কলমে ওরা আমার বুকে বিষ ছড়ালো। বিষে বিষে আমি হলাম জর্জরিত এবং আমার দ্বারা সমাজ হলো বিষাক্ত।
আামি এক মযলূম ভাষা, আমি বাংলাভাষা! আমার সর্বাঙ্গে এখন পচন-ধরা ঘা। বিষের জ্বালায় আমি এখন শুধু ছটফট করি, আর আর্তনাদ করি। বিশ্বাস ছিলো একদিন তোমাদের কানে পৌঁছবে আমার আর্তনাদ। ফিরে আসবে তোমাদের চেতনা ও গায়রাত। বিলম্বে হলেও তোমরা এগিয়ে আসবে বাতিলের থাবা থেকে আমাকে উদ্ধার করতে। কিন্তু তোমরা এলে না, তোমরা জাগলে না। আমি লাঞ্ছিত হলাম; একদল পশুর হাতে আমি ধর্ষিত হলাম।
ফল কী হলো আমার প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার! দেশ ও সমাজের কাছে তোমরাও হলে অবহেলা ও অবজ্ঞার পাত্র! এমনই হয়, মায়ের ভাষাকে যারা অবজ্ঞা করে দেশ ও সমাজের কাছে তারা নিজেরাই হয়ে পড়ে অবজ্ঞার পাত্র।
আর কতকাল থাকবে অচেতন গাফলাতের ঘুমে? একদিন তো দাঁড়াতে হবে আল্লাহর সামনে। সেদিন আমি ফরিয়াদ জানাবো আল্লাহর কাছে। সেদিন আমি নালিশ দায়ের করবো তোমাদের নামে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তো কাওমের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছো তাঁর মুখে তাঁর কাওমের ভাষা দিয়ে, যেন তিনি তাদের সামনে প্রচার করতে পারেন হকের দাওয়াত এবং সত্যের বাণী। কিন্তু এরা আমাকে পরিত্যাগ করেছিলো হে আল্লাহ! ফলে তোমার দুশমনদের হাতে আমার ইজ্জত-আবরু হয়েছে লুণ্ঠিত! আমি হয়েছি জাহেলিয়াতের বাহন। হে আল্লাহ আমি বিচার চাই, আমি ইনছাফ চাই।’
তখন কী কৈফিয়ত পেশ করবে তোমরা আল্লাহর কাছে? কী জবাব আছে তোমাদের কাছে আমার নালিশের?
এখনো সময় আছে। ওঠো, জাগো। আমার বর্ণমালাকে গ্রহণ করো, আমার শব্দমালাকে বরণ করো। অন্যায় ও বাতিলের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করো। ন্যায় ও সত্যের বাহনরূপে আমাকে ব্যবহার করো। তাদের হাতে আছে ‘কলমের দড়ি’, তোমরা হাতে নাও ‘কলমের লাঠি’। দেখবে, বাতিলের সব জাদু-কারসাজি হয়ে যাবে নাস্তানাবুদ। মিথ্যার অন্ধকার বিদূরিত হবে এবং সত্যের আলোতে সমাজ আলোকিত হবে। দ্বীনের চূড়ান্ত বিজয় হবে এবং তোমাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে, সমাজে এবং মানুষের হৃদয়ে। তোমরা আমাকে উদ্ধার করো এবং প্রতিষ্ঠিত করো আমার প্রাপ্য মর্যাদায়; আমি তোমাদের সমাসীন করবো সমাজের নেতৃত্বের আসনে। যদি না করো তাহলে দুনিয়াতে পাবে শুধু যিল্লতি ও লাঞ্ছনা, আর আখেরাতে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে আসামীর কাঠগড়ায়।
সূত্রঃ দারুল কলম প্রকাশিত "এসো কলম মেরামত করি" গ্রন্থ