ড. সৈয়দ আলী আশরাফের মুসলিম ট্রেডিশনস ইন বাংলা লিটারেচার: একটি পর্যালোচনা

ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতিমান অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, কবি এবং সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ আলী আশরাফ [মরহুম] তাঁর "Muslim Traditions in Bengali Language" শীর্ষক গ্রন্থে মুসলিম লেখকদের দ্বারা সৃষ্ট মৌলিক ঐতিহ্যধারার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট সময়কালের সকল লেখকই এ ধারার কিছু না কিছু অংশকে গ্রহণ করেছেন। এ বইটি হলো বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানের সরল উপস্থাপনার পরিবর্তে মুসলিম লেখকদের দ্বারা সৃষ্ট ঐতিহ্যিক দিকটি নিয়ে সমৃদ্ধ সমালোচনামূলক জরিপ।

ড. সৈয়দ আলী আশরাফ বাংলা সাহিত্যে মৌলিক ঐতিহ্যধারাসমূহের প্রকারভেদ, উৎপত্তি, বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি, অপরাপর ঐতিহ্যের গঠন এবং মধ্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ঐতিহ্যধারাকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন এই গ্রন্থে। এখানে তিনি বক্তব্য, গঠন  এবং পরিভাষার ভিত্তিতে কেবল প্রধান ঐতিহ্যগুলোকে নির্বাচন করেছেন। তিনি সচেতনভাবে দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে ঐতিহ্যের এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।

"Muslim Traditions in Bengali Language" শীর্ষক গ্রন্থটির মূল্যমান নির্ধারণ করা পাঠকের পক্ষে কঠিন নয়। এটি একটি সাহিত্য সমালোচনা হিসেবে অতি উঁচুস্তরের মর্যাদার দাবী রাখে। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে যখন মুসলিম সমাজের উদ্ভব ও বিস্তৃতি ঘটে তা থেকে আধুনিক যুগের বিকাশ অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তিকরণ পর্যন্ত মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনবোধের উন্মোচন করা হয়েছে এ গ্রন্থটিতে।

গ্রন্থটির প্রারম্ভিক অধ্যায়ে লেখক বাংলা সাহিত্যের দু’টি মৌলিক ঐতিহ্যধারার ভূমিকা উপস্থাপন করেছেন। বাস্তবকে অবজ্ঞা না করে তিনি লিখেন, “Though the Hindu and the Muslim societies speak the same language, breathe the same air, live in the same land, they have consistently followed different historical treads, responded differently to the same situations and hence created different formal, linguistic and thematic traditions.”[Page-5] অর্থাৎ “যদিও হিন্দু ও মুসলমানেরা একই ভাষায় কথা বলেন, একই বাতাস নিঃশ্বাসে গ্রহণ করেন, বাস করেন অভিন্ন ভূমিতে, তা সত্ত্বেও তাঁরা ভিন্ন ঐতিহাসিক স্রোতধারাকে অনুসরণ করেন, একই পরিস্থিতিতে তাঁরা আলাদাভাবে সাড়া দেন এবং এভাবে তাঁরা সৃষ্টি করেছেন আঙ্গিক, ভাষিক ও বিষয়বস্তু নির্ভর ভিন্ন ঐতিহ্য।” যথার্থই তিনি লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্য এভাবে একটি নদী যার দু’টি স্রোতধারা বহমান। ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে বিশ্লেষণ করে গ্রন্থকার দেখিয়েছেন এ দু’সমাজের সাহিত্য ঐতিহ্য ভিন্ন। এ ভিন্ন দু’ ঐতিহ্য ধারাই সম্মিলিতভাবে বাংলা সাহিত্যকে শক্তিশালী করে তুলেছে। তাঁর মতে বাংলা সাহিত্য হলো “পদ্মা ও মেঘনার মিলিত বেগবান নদী সঙ্গমের মত [mighty confluence like the Padma and the Meghna]।” অধিকন্তু, প্রতীক, আদর্শ ও রাজনীতির বিচারে জীবনের প্রতি হিন্দু ও মুসলমানদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তারপরও এ দু’ঐতিহ্যধারার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া এবং একে অপরের প্রতি প্রভাব বিদ্যমান। লেখক উল্লেখ করেন, বৈষ্ণব পদাবলী এ দু’ঐতিহ্যধারার চমৎকার মিথস্ক্রিয়াকে নির্দেশ করে। গ্রন্থটির মূল পাঠে যেভাবে লিখিত আছে। “The Vaishnava Padavalees indicate an interesting interaction of the two traditions”.

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব ও সংস্কৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে হিন্দু সমাজ মুসলমান সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার চেষ্টা করেছেন, এটা কিভাবে হিন্দু সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে মুসলমান লেখকদের সাহিত্য ‘যোগ কালান্দা’ ভক্তিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। একই অধ্যায়ে লেখক হিন্দু ও মুসলমান সম্পদ্রায়ের ভিন্ন আন্দোলন এবং সাহিত্যে তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন কিভাবে ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্যমুখী ও পাশ্চাত্য বিরোধী জীবন দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে।

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আঙ্গিক, ভাষিক ও বিষয়বস্তু নির্ভর ঐতিহ্যসমূহ যে প্রভাব রেখেছে তা গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, “By 1350 A.D. the Muslims had united the different regions of Bengal and started becoming patrons of Bengali language and literature, thus providing an impetus to new literary productions.” [Page-32] অর্থাৎ “১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বাংলার বিভিন্ন অংশকে মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার মধ্য দিয়ে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করবার একটি সংবেগ দান করেন।”

চতুর্থ অধ্যায়ে অধ্যাপক আশরাফ উল্লেখ করেন, ‘মুসলমান লেখকেরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যকে লালন করা অব্যাহত রাখেন এবং তা তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক, মর্যাদাবোধের কারণেই। অপরদিকে হিন্দু লেখকদের পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে স্বাভাবিক কারণেই বিকাশ ঘটে।”

উপসংহারমূলক অধ্যায়ের ভূমিকায় অধ্যাপক আশরাফ তাঁর অভিমত উল্লেখ করে বলেন, “১৯৪৭ সালটি ছিল চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী একটি বছর [শুধু রাজনৈতিকভাবে কেন বাংলা সাহিত্যেরর জন্যও বটে]। পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলায় বাংলা বিভক্তি এবং পূর্ব ও পশ্চিমে লেখকদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে পূর্ব বাংলার লেখকবৃন্দ নিজ দেশ, আবহাওয়া এবং জনগণের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন ঐতিহ্যধারা সৃষ্টি করতে প্রয়াস পান।” [পৃ:৭৫] একই অধ্যায়ে সর্বশেষ অনুচ্ছেদে তিনি এর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

গ্রন্থটি পাঁচটি অধ্যায় নিয়ে রচিত। আরও অধ্যায় ভিত্তিক টীকা, প্রয়োজনীয় মন্তব্য ও তথ্যপঞ্জী সরবরাহ করেছেন গ্রন্থাকার। তাছাড়া ‘নির্বাচিত শব্দকোষ’ [Selective Glossary] উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্যিক পরিভাষা পাঠকদের নিকট সুস্পষ্ট করবার জন্য যাতে তাঁরা সহজে বইটি বুঝতে সক্ষম হন।

বইটির ‘মুখবন্ধ’ লিখতে যেয়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশের তৎকালীন মহাপরিচালক জনাব এ. এফ. এম. ইয়াহিয়া উল্লেখ করেছেন, বাংলা সাহিত্যের পুরাতন ও আধুনিক অধ্যায়ের ঐতিহ্যের পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্যই শুধু গ্রন্থকার উল্লেখ করেননি, বাঙালি মুসলমান লেখকের আধুনিক সময়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাও তিনি নির্দেশ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “Dr. Ali Ashraf not only analyzed the distinctive features of Muslim tradition in Bengali literature both in its old and modern phases, he also indicated the problems which the Bengali Muslim writers have been facing in modern times.”

এই গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনাধর্মী বিশ্লেষণ করবার খুব সম্ভবত প্রথম প্রয়াস। এ পুস্তকের প্রকাশক হওয়ায় ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ বাংলাভাষা ও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে ধন্যবাদার্হ ও কৃতজ্ঞভাজন।

গ্রন্থকার স্বীকার করেছেন এ গ্রন্থটি বিভিন্ন সাময়িকীতে পূর্বে প্রকাশিত তাঁর লেখার বিস্তৃত ও পুনর্লিখিত রূপ। নিঃসন্দেহে, লেখকের বাংলা সাহিত্যের উপর কয়েক দশকের পরিশ্রমী ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনুসন্ধান ও গবেষণার ফলে গ্রন্থটি দিবালোকে হাজির হতে পেরেছে। এতদসত্ত্বেও এ গ্রন্থটিতে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যের সামগ্রিক দিক [all comprehensiveness] সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না, যা তিনি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। এ বিনয়ের কারণে তাঁর পাণ্ডিত্যকে আমাদের সমীহ করতে হয়। বাংলা সাহিত্যের যে কোন উৎসাহীজনের নিকট গ্রন্থটি উপকারী ও অসাধারণ বলে বিবেচিত। আরেকটি তথ্য হলো, বাংলাভাষীদের নিকট এ গ্রন্থের গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংরেজি থেকে বাংলায় লেখক নিজেই এটির ভাষান্তর করেছেন ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য’ শিরোনামে।

সূত্রঃ সাহিত্য ত্রৈমাসিক প্রেক্ষণ অক্টবর-ডিসেম্বর ২০০৬ (সৈয়দ আলী আশরাফ স্মরণ)