মরিয়ম জামিলা

খ্যাতনামা মুসলিম লেখিকা মরিয়ম জামিলা ২৩ মে ১৯৩৪ সালে নিউইয়র্কে এক জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁকে আমেরিকান ইহুদী নারীদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মনে করা হয়। মার্গারেট মার্কাস নাম্নী এই মহিয়সী নারী শৈশব থেকে মানসিক রোগাক্রান্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অসুস্থতার জন্য তাঁকে কয়েকবার বিরতি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে অনার্স শেষ না করেই শিক্ষাজীবন শেষ করতে হয়। স্কুল জীবনেই তিনি আরব সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশেষত: আরব ও ফিলিস্তীনীদের দুর্ভোগ তাকে চরমভাবে ব্যথিত করে তুলেছিল। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি ফিলিস্তীনী আশ্রয়শিবিরকে কেন্দ্র করে একটি গল্পগ্রন্থ লেখেন। একজন ভালো চিত্রকরও ছিলেন তিনি। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইহুদীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপের সংস্পর্শে আসেন, কিন্তু তাদের সকলেই জায়নবাদকে সমর্থন করায় তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না।

১৯৫৩ সালে অসুস্থতায় পড়ার পর তিনি ইসলাম ও কুরআনকে জানার সুযোগ পান এবং এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। মুহাম্মাদ আসাদের বিখ্যাত The Road to Mecca বইটিও তাকে অনুপ্রাণিত করে যা তাকে ইসলাম গ্রহণের পথ তৈরী করে দেয়। ১৯৫৭-৫৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দু’বছর তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়। সুস্থ হওয়ার পর তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। দেশ-বিদেশের ইসলামী ব্যক্তিত্বগণের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। বিশেষ করে পাকিস্তান জামা‘আতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মওদূদীর সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালের মে মাসে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মরিয়ম জামীলা নাম ধারণ করেন।

১৯৬২ সালে তিনি মাওলানা মওদূদীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানে গমন করেন এবং সেখানেই ১৯৬৩ সালে মুহাম্মাদ ইউসুফের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তী কয়েকবছর গভীরভাবে তিনি ইসলামের উপর পড়াশোনা করেন। অতঃপর লেখালেখির সাথে যুক্ত হন। সূক্ষ্ম ও সাহসী চেতনাশক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে আমদানীকৃত পশ্চিমা বস্তুবাদ, ধনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও তথাকথিত আধুনিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরিণত হন একজন খ্যাতনামা কলমসৈনিকে। তাঁর সকল লেখনীতে পশ্চিমাদের মত তথাকথিত আধুনিক মুসলিমদেরকেও কোনরূপ ছাড় দেননি। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিরিশটি। এছাড়াও বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। উর্দূ, ফারসী, বাংলা, তুর্কী, ইন্দোনেশিয়ান প্রভৃতি ভাষায় তার বেশ কিছু বই অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর যাবতীয় রচনা, বক্তব্য, ভিডিও ক্যাসেট, চিত্রকর্ম বর্তমানে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রয়েছে।

তার প্রসিদ্ধ কয়েকটি বই হল- ইসলাম ও আধুনিকতা, পশ্চিমাকরণ এবং মানবকল্যাণ, ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য, ইসলাম বনাম আহলে কিতাব : অতীত ও বর্তমান, ইসলাম ও পশ্চিমা সমাজ, ইসলাম ও আজকের মুসলিম নারী সমাজ, ইসলামী সংস্কৃতি : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইসলাম ও আধুনিক মানুষ, পশ্চিমাকরণ বনাম মুসলিম জনগণ ইত্যাদি। যে অসাধারণ প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার প্রতিটি বইয়ে তা এককথায় অসাধারণ। গত শতকে তার মত বিদূষী মুসলিম নারী লেখিকার উদাহরণ খুব কম। এই মহীয়সি মুসলিম নারী ৩১ অক্টবর ২০১২ সালে পরলোক গমন করেন। তাঁর অবদানের জন্য মুসলিম উম্মাহ কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণ করবে।