ইসলাম যেভাবে ইউরোপ সৃষ্টি করেছিল

ইউরোপ অপরিহার্যভাবেই ইসলাম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ছিল। ইসলাম আবারো ইউরোপকে পুনঃসংজ্ঞায়নে কাজ করছে। প্রাচীনযুগের প্রাথমিক এবং মধ্যবর্তী সময়ে কয়েক শতাব্দীকাল জুড়ে ইউরোপ বলতে ভূমধ্যসাগর দ্বারা বেষ্টিত বিশ্বকেই বুঝাতো। যাকে রোমানদের সুবিদিত ভাষায় “Mare Nostrum” বা  “আমাদের সাগর” বলে অভিহিত করা হত। তখনকার ইউরোপ উত্তর আফ্রিকা পর্যন্তও বিস্তৃত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে সেইন্ট অগাস্টিন যখন আজকের উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়াতে বাস করতেন তখন তা ছিল ইতালি এবং গ্রিস এর মতই খ্রিস্টবাদের একটি কেন্দ্র।

 কিন্তু সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ইসলামের দ্রুত অগ্রগতি সাধনের ফলে সেখানে খ্রিস্টবাদের কার্যত অবসান ঘটে। ফলশ্রুতিতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল দুটো সভ্যতায় বিভক্ত হয়। ভূমধ্যসাগর সভ্যতা দুটোর মধ্যে ঐক্যের শক্তি হবার পরিবর্তে তাদের মধ্যে এক কঠিন সীমান্তরেখা হয়ে দেখা দিল। স্পেনীয় দার্শনিক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেত এর মতে সেই সময় থেকেই ইউরোপের সকল ইতিহাস ব্যাপকভাবে উত্তরমুখী হতে শুরু করল।

রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাবার পর সেই উত্তরমুখীতা একটি বিষয় প্রত্যক্ষ করল। তা হ্ল জার্মানিক (গোথ, ভ্যান্ডাল, ফ্র্যাংক এবং লোম্বার্ড) জাতির মানুষ ক্লাসিকাল গ্রিক ও রোমের ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার মূলশিকর গড়ে তুলল যা অনেক পরেই আবিস্কৃত হয়েছিল। আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আরো অনেক শতাব্দী সময় লেগে গিয়েছিল। ধীরগতি সত্ত্বেও, সামন্ততন্ত্রের সম্মতিসুচক লেনদেন পদ্ধতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পথে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করেছিল যা গোড়ার দিকে আধুনিক সাম্রাজ্য এবং সময়ের সাথে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের জন্য পথ সুগম করে দিয়েছিল। এই পথ ধরে নব্য স্বাধীনতা এনলাইটমেণ্টকে কর্তৃত্বের আসনে আসীন করে। সংক্ষেপে, উত্তর ইউরোপে খুব ধীর এবং জটিল প্রক্রিয়ায় “পশ্চিম” এর যে আবির্ভাব হয়েছিল তা মূলত ইসলাম ভূমধ্যসাগরকে বিভক্ত করার পর সংঘটিত হয়।

ইসলাম ভৌগলিক দিক থেকে ইউরোপ কে নির্ধারণ করা ছাড়াও আরো অনেক বেশি কিছু করেছে। ডেনিস হায় নামের একজন বৃটিশ ইতিহাসবিদ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার অসাধারণ কিন্তু কিছুটা ঘোলাটে বই “ইউরোপ: দি ইমারজেন্স অফ এন আইডিয়া” তে  ব্যাখ্যা করেছেন ইউরোপীয় ঐক্য খ্রিষ্টবাদের ধারণা উপর ভিত্তি করে শুরু হয়েছিল যার একটি উদাহরণ The Song of Ronald. এটা ইসলামের বিপক্ষে “অনিবার্য বিরোধিতা” ছিল যা ক্রুসেডের সময় চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল।

এডওয়ার্ড সাইদ মত স্কলার ১৯৭৮ সালে তার বই “ওরিয়েন্টালিজম” এ ইউরোপের ইসলাম বিরোধিতা দেখানোর মাধ্যমে বলেন যে ইসলাম ইউরোপকে সাংস্কৃতিক ভাবে নির্মান করেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে ইউরোপের নিজস্ব পরিচয় উল্লেখযোগ্যভাবে তার প্রান্তসীমায় অবস্থিত আরব মুসলিম বিশ্বের বিপরীতে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল। সাম্রাজ্যবাদ এই বিবর্তনের চূড়ান্ত প্রকাশকে প্রমাণ করেছে। প্রাথমিক অবস্থায় আধুনিক ইউরোপ শুরু হয়েছিল নেপোলিয়নের সময়। তিনি মধ্যপ্রাচ্য জয় করেছিলেন এবং স্কলার ও কুটনিতিকদের সেখানে পাঠালেন ইসলামি সভ্যতা নিয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। যেই সভ্যতাকে তিনি শ্রেনীভুক্ত করেছিলেন সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচু শ্রেণির বলে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে উত্তর আফ্রিকা ও লেভান্তের নতুন পুলিশ রাষ্ট্রগুলো ইউরোপের সাংস্কৃতিক উৎকৃষ্টতাকে শক্তিশালী করেছিল। এই স্বৈরশাসনের মাধ্যমে দেশগুলো নিজেদের জনগণকে একটি সুরক্ষিত সীমানার মধ্যে বন্দি হিসেবেই রাখতো। আর এই সীমানাগুলো ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রতিনিধিরাই কৃত্রিমভাবে নির্ধারণ করেছিল। যার ফলে ইউরোপিয়ানরা যেকোন ধরনের নোংরা গণতান্ত্রিক পরীক্ষার সম্ভাবনার দুশ্চিন্তা ছাড়াই আরবদের মানবাধিকার বিষয়ে মুরব্বিয়ানা করতে পারতো। এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অভিবাসনের ঘটনা ঘটত। কারণ আরবদের মধ্যে মানবাধিকারের ঘাটতি ছিল যা ইউরোপিয়ানদের আরবদের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং নিরাপদ ভাবার অনুভূতি এনে দেয়।

ইসলাম আজ তাই ভাঙ্গছে যা সে একসময় নিজে সৃষ্টি করেছিল। একটি ধ্রুপদি ভৌগলিক কাঠামো আবারো নিজেকে সাংগঠনিকভাবে তুলে ধরছে। সন্ত্রাসবাদ এবং অভিবাসন- এ দুয়ের জোয়ার উত্তর আফ্রিকা ও লেভান্তসহ ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় অবস্থিত ভূ-অঞ্চলকে আবারো ইউরোপের সাথে যুক্ত করছে। অবশ্য মহাদেশটি এর আগেও অনেক জাতিকে আত্নীভূত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব থেকে গণবিস্ফোরনের ন্যায় আগত জনগোষ্ঠীর দ্বারা ইউরোপ নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। মধ্যযুগে বিপুল পরিমানে স্লাভ এবং ম্যাগীয়াররা ইউরেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপে দেশান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু উত্তরের পোল্যান্ড থেকে দক্ষিণের বুলগেরিয়া পর্যন্ত সেই মানুষগুলো খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করেছিল এবং বিকাশমান ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিল যদিও এর জন্য অনেক রক্তপাতও হয়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালীন আলজেরিয়ান সল্পমেয়াদী শ্রমিক যারা ফ্রান্সে গমন করেছিল এবং তুর্কি ও কুর্দি সল্পমেয়াদী শ্রমিক যারা জার্মানিতে গমন করেছিল তারা বর্তমান অভিবাসন জনগোষ্ঠীর অগ্রদূত বলা যেতে পারে।

আজ হাজার হাজার মুসলিম অর্থনৈতিকভাবে স্থবির ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রবেশ করছে যাদের খ্রিস্টান হবার বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা নেই। ইউরোপের ভঙ্গুর সামাজিক শান্তির জন্য তারা হুমকিস্বরুপ দেখা দিচ্ছে। যদিও ইউরোপের এলিটরা যুগ যুগ ধরে এক ধরণের আদর্শবাদী বয়ানের মাধ্যমে বরাবরই ধর্ম এবং জাতির এই শক্তিকে অস্বীকার করে আসছে, তথাপি এটা হচ্ছে সেই শক্তি যা ইউরোপের দেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ বন্ধন গঠনে সাহায্য করেছিল।

ইতিমধ্যে, এই নতুন অভিবাসন প্রক্রিয়া যা রাষ্ট্রগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা এবং যুদ্ধের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তা সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্র এবং তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর মধ্যকার দুরত্ব মুছে দিচ্ছে। প্রাচ্যবাদ, যার মাধ্যমে একটি সংস্কৃতি অপর একটি সংস্কৃতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে এবং প্রাধান্য বিস্তার করে তা এই বিশ্বজনীন যোগাযোগ ও তুলনামূলক অধ্যয়নের পৃথিবীতে ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যা সাইদ পূর্বেই অনুমান করেছিলেন। একসময় শাসন করা সভ্যতাগুলো থেকে আসা হুমকির ফলশ্রুতিতে ইউরোপ তার জাতীয়-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তীব্র ডান অথবা বাম পন্থায় অনেকটা কৃত্রিমভাবে পুনর্গঠন করছে।

যদিও সব ধরনের জাতিগত এবং আঞ্চলিক বিবাদের ইতিহাস সমাপ্তের ধারণা অনেকটা কল্পনায় পরিণত হয়েছিল, কিন্তু এই উপলব্ধি জাতীয়তাবাদের ধারণায় পুনরায় ফিরে আসার কোন অজুহাত হতে পারে না। মুসলিম শরনার্থী আগমনের মুখে ইউরোপের সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতা রক্ষার যে আবেদন তা ক্রমবর্ধমান মানবিক যোগাযোগের বিশ্বে স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব।

ভৌগলিক কাঠামোর বাহিরে পশ্চিমা বিশ্ব বলে যদি কোন অর্থ থেকে থাকে তাহলে তা আরো বেশি সহনশীল লিবারেলিজমের চেতনা ধারণ করে। উনবিংশ শতকে যেমন কেউ সামন্তবাদে ফিরে যায়নি আজও তেমনি কেউ জাতীয়তাবাদে ফিরে যাচ্ছেনা যদি না কোন দুর্যোগ ডেকে আনতে চায়। বিখ্যাত রাশিয়ান বুদ্ধিজীবী আলেকজান্ডার হার্জেন বলেন, “ ইতিহাস ফিরে আসে না….সব পুনঃনির্মাণ ও পুনরুদ্ধার সবসময় শুধুই মুখোশধারী ছলনা।”

এভাবে প্রশ্নের সূচনা হয় যে, সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে কে তাহলে রোমের স্থান গ্রহণ করবে? সাইদ বলেন, সাম্রাজ্যের অবশ্যই খারাপ দিক আছে। কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিশাল বহুজাতীয় মানুষকে শাসনের যে সক্ষমতা তা এই ক্ষেত্রে একটা সমাধান ছিল যার অস্তিত্ব আজ আর নেই।

ইউরোপের উচিত এমন কিছু বিকল্প সন্ধান করা যাতে সে দ্রুততার সাথে মুসলিম বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে একাত্ম করে নিতে পারে। যার ফলে উত্তর ইউরোপে গড়ে ওঠা আইনের শাসনের প্রতিও তাদের নিবেদনে কোন ভাটা পড়বেনা। এটা হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারকে চাহিদার ক্রমধারায় সবার শীর্ষে রাখা হয়। এটা যদি সার্বজনীন মুল্যবোধের পথে বিবর্তিত না হয় তাহলে আদর্শ ও নিকৃষ্ট জাতীয়তাবাদের উন্মত্ততা দিয়েই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। এবং এটাই হবে ইউরোপে “পশ্চিম” এর পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত।

সূত্রঃ The Atlantic