দা’য়ীর জীবনে বড় বড় বাঁক বা মোড়

জীবন যুদ্ধে ঘাত-প্রতিঘাত রয়েছে, রয়েছে বড় বড় বাঁক বা মোড়। আল্লাহর পথে দায়ীদেরকেও এসব বাঁক মাড়িয়ে এগুতে হবে। ইসলামের পথে কর্মরত ভাইয়েরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের জীবনেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ, লাভ-লোকসান হিসাব মিলাতে গিয়ে আসে নানা বাঁক বা বাঁধা।

বাস্তবে অনেক দা’য়ী ব্যক্তিগত লোভ লালসার জন্য জীবন সঙ্গিনী চয়নে এমন একজন সাথী বাছাই করে, যে দাওয়াতের ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না। এটা সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি বয়ে আনে। কর্মজীবনে প্রবেশ করে সে বিরাট হোঁচট খায়। তারা শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরে যায়। জীবন প্রবাহের গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দেয়।

দা’য়ীর সমাজ যেহেতু জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়, এজন্য অনেক সময় দা’য়ী সমাজের প্রচলিত ভাবধারার সাথে তার প্রভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে না। সে কলুষিত হয়ে পড়ে। এ বিষয়টিকে একটু ব্যাখ্যা করে বলতে চাই-

১ম বাঁক- স্ত্রী

স্ত্রী দা’য়ীর জীবনে, সমস্ত মানুষের জীবনে এক বিরাট ভূমিকা রাখে। সে যেমন নেয়ামতের উৎস হতে পারে, তেমনি আবার হতে পারে দুর্ভাগ্যের উৎস। দা’য়ীর দাওয়াতের ক্ষেত্রেও এই দুই ধরণেরই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। অনেক দা’য়ীর বিবাহোত্তর জীবনে আরো সুন্দরভাবে ইসলাম প্রভাব ফেলেছে। তারা ইসলামের সঠিক পথে অগ্রসর হয়েছে। তাদের ইসলামের খেদমত আরো বেগবান হয়েছে। আবার অনেকেরই বিবাহত্তোর জীবনে চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে। ইসলামের প্রতি আগ্রহ উদ্দীপনা কমেছে। এমনকি অনেকে দাওয়াতের পথ থেকে সরে গেছেন।

নিঃসন্দেহে বলা যায় এই ফলাফলের পিছনেও কার্যকারণ রয়েছে, যারা দাম্পত্য জীবনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী শর্ত শরায়েত এবং বিধি-বিধানের প্রতি তেমন গুরুত্ত্ব দেন নাই। যার ফলে যা হবার তাই হয়েছে। তারা পরবর্তীতে আফসোস করেছেন কিন্তু যা হওয়ার তা তো ঘটেই গেছে।

ইসলাম দাম্পত্য জীবনকে সঠিক ভাবে গড়ে তোলার কতিপয় দিক দির্দেশনা প্রদান করেছে। আমরা সেগুলো এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সঠিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ

ইসলাম বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনি বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং বিবাহকে দ্বীনের পূর্ণতা হিসাবে গণ্য করেছে।

রাসূল (সা) বলেছেন- যে ব্যক্তিকে আল্লাহ সৎ স্ত্রী দান করলেন তাকে অবশ্যই দ্বীনের অর্ধেক রক্ষা করায় সহায়তা করলেন। সুতরাং সে যেন বাকি অর্ধেককে রক্ষা করার জন্য আল্লাহকে ভয় করে চলে।

বায়হাকীর অপর বর্ণনায় রাসুল (সাঃ) বলেছেন- যখন বান্দা বিবাহ করে তখন তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণতা পায়, সুতরাং সে যেন বাকী অর্ধেক পূরণ করার জন্য আল্লাহকে ভয় করে চলে।

ইসলাম বিবাহ ব্যবস্থাকে নফসকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য এবং একে আল্লাহর আনুগত্যের পথে চরিত্র নিষ্কলুষ রাখার জন্য এক বিশেষ কার্যকারণ হিসেবে গণ্য করেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ রয়েছে, তারা যেন বিয়ে করে। আর বিয়ে করার সামর্থ না থাকলে রোযা রাখে। কেননা এটাই তার জন্য ঢাল সরূপ।

বিশিষ্ট দার্শণিক প্লেটো বলেন- মানুষ সর্বদা ভীতি, অতৃপ্তিতে ভুগে থাকে, যেনো তার মাঝে একটি অংশ নেই। যখন তার বিবাহ দেওয়া হয় তখন সে তার হারানো অংশটি ফিরে পায় এবং তার মধ্য পূর্ণতা, তৃপ্তি এবং স্থিরতা ফিরে আসে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন- তিন প্রকার লোককে সাহায্য করা আল্লাহর উপর আবশ্যকীয় হয়ে যায়। আল্লাহর পথে যুদ্ধরত যোদ্ধা, চুক্তিবদ্ধ গোলাম, যে স্বাধীন হতে চায় এবং যে ব্যক্তি চরিত্র নিষ্কলুষ রাখার জন্য বিবাহ করতে চায়।

ইসলামে বিবাহের একটি বিশেষ লক্ষ্য হল- নিরাপদ পারিবারিক বন্ধন গড়ে তোলা, আর এ ক্ষেত্রে প্রথম ভিত্তি হচ্ছে, বিবাহ। এই ভিত্তি যদি সঠিক হয় তাহলে এই ভবনও সঠিক হবে বলে আশা করা যায়। এ বিষয়টি প্রতি লক্ষ্য করে মুমিমদের মনের আকুতি মিনুতিকে কুরআন মাজীদে এভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যারা বলে হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন- যারা আমাদের চক্ষু জুড়াবে আর আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন। (সূরা আল-ফুরকানঃ৭৪)

কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য যদি শুধু মাত্র যৌন চাহিদা মিটানোই হয় তাহলে তাদের কাছে যৌনতা ছাড়া দয়া, মায়া, মহব্বত, ভালবাসা ও স্নেহের কিছুই আশা করা যায় না।

ইসলাম সঠিক সাথী নির্বাচনের জন্য বিশেষভাবে তাগাদা দিয়েছে। যদি মহিলার মধ্যে পাওয়া যায়- ভালো মন ও মানসিকতা, তাহলে সেতো সবচেয়ে ভালো মহিলা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর বাণী মোতাবেক “মহিলাদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে সেই মহিলা, যার দিকে তার স্বামী দৃষ্টি দিলে সে আনন্দিত হবে আর যদি তাকে কোন কাজের আদেশ দেয়, তাহলে সে তার আনুগত্য করবে এবং যখন সে তার থেকে অনুপস্থিত থাকবে তখন সে তার ধন-সম্পদ, নিজের নফস এবং টাকা-পয়সার হেফাযত করবে”।

সুতরাং আমার ভাইদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে, ইসলাম কিভাবে শয়তান থেকে বাঁচার ব্যাপারে আমাদেরকে পথের নির্দেশনা দিয়েছে। টাকার-পয়সার পূর্বে স্বভাব-চরিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং মহান আল্লাহর আহবানে সাড়া দিতে হবে। তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের অবিবাহিতদেরকে এবং তোমাদের সৎ দাস-দাসীদেরকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। যদি তারা দরিদ্রও হয়, আল্লাহ তাদেরকে তার করুণা দিয়ে সম্পদশালী করে দিবেন”।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এ বাণীকেও সামনে রাখতে হবে, তিনি বলেছেন- কেউ যদি কোন মহিলাকে সম্মান প্রতিপত্তি লাভের জন্য বিয়ে করে, তাহলে আল্লাহ তার অপমান বাড়িয়ে দিবেন আর কোন মহিলাকে যদি টাকা পয়সার লোভে বিয়ে করেও, তাহলে আল্লাহ তাকে অধিকতর দরিদ্র করে দিবেন এবং কেউ যদি আভিজাত্য লাভের জন্য বিয়ে করে কোন মহিলাকে তাহলে সে আরো বেশি লাঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে কেউ যদি নিজের চক্ষুকে সংযত করতে, লজ্জাস্থান হেফাযত করতে এবং আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে তাহলে আল্লাহ তাদের উভয়ের মধ্যে কল্যাণ ও বরকত দান করবেন।


সূত্রঃ ওয়ামী (ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অব মুসলিম ইয়ুথ) প্রকাশিত “দা’য়ীর আত্মপর্যালোচনা” গ্রন্থ